মসজিদ-মন্দির পেল রেলওয়ে জমি, সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো। দেশের মানুষ বহু বছর ধরে বিভিন্ন উন্নয়ন, সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সাক্ষী থাকলেও এবার প্রথমবারের মতো ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর জন্য প্রতীকী মূল্যে জমি বরাদ্দ দিয়ে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়। রাজধানীর জোয়ার সাহারা মৌজায় অবস্থিত দুটি মসজিদ এবং একটি মন্দিরকে এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এই বরাদ্দ শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি বাংলাদেশে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের বাস্তব প্রতিফলন। রেলওয়ের পক্ষ থেকে এই জমি প্রতিটি উপাসনালয়কে প্রতীকী মূল্যে—প্রতিটি মাত্র ১ হাজার ১ টাকা, অর্থাৎ মোট ৩ হাজার ৩ টাকায়—বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার রেলভবনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে এই জমি বরাদ্দপত্র হস্তান্তর করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এছাড়াও ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকার বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মো. মহিউদ্দিন আরিফ আনুষ্ঠানিকভাবে জমির কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট পরিচালনা কমিটির কাছে তুলে দেন।
১. খিলক্ষেত রেলওয়ে জামে মসজিদ: ০.২০১১ একর বা ৮,৭৬০ বর্গফুট।
২. আন-নূর-জামে মসজিদ: ০.০৫৫২ একর বা ২,৪০৫ বর্গফুট।
৩. খিলক্ষেত সার্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির: ০.০৫৬২ একর বা ২,৪৫০ বর্গফুট।
মোট প্রায় ৩১ শতাংশ জমি এই তিনটি উপাসনালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এই সিদ্ধান্তকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
“বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের রোল মডেল। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে বাস করে। রেলওয়ের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এই সম্প্রীতির ধারাকে এগিয়ে নিচ্ছে।”
বাংলাদেশ একটি বহুধর্মীয় ও বহুজাতিক রাষ্ট্র। দীর্ঘ ইতিহাসে দেশটি ধর্মীয় সম্প্রীতির কারণে বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এই সম্প্রীতিকে নষ্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন উদ্যোগ সামগ্রিকভাবে জনগণের মনে নতুন আস্থা সৃষ্টি করে।
রেলওয়ের অধীনে থাকা জমিগুলো বিভিন্ন সময়ে লিজ বা প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ধর্মীয় উপাসনালয়ের জন্য প্রতীকী মূল্যে জমি দেওয়ার নজির এই প্রথম। এতে বোঝা যায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির দিকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে।
খিলক্ষেত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে মসজিদ ও মন্দির পরিচালনায় জমি নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। এখন সরকারি উদ্যোগে বৈধতা পেয়ে তারা স্বস্তি পেয়েছেন।
একজন স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি বলেন,
“এটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। অনেক বছর ধরে আমরা এই জায়গায় নামাজ আদায় করছি। এখন সরকারিভাবে জমি পাওয়ায় ভবিষ্যতে আর কোনো জটিলতা থাকবে না।”
অন্যদিকে মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক বলেন,
“আমাদের জন্য এটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রতীকী মূল্যে জমি পাওয়া মানে শুধু সম্পত্তি পাওয়া নয়, বরং এটি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রতীক।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি ধর্মীয় উদ্যোগ নয়, বরং রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশকে ঐক্যের বার্তা দিতে চায়। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত একটি বড় পদক্ষেপ।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো। ভবিষ্যতে দেশের অন্য জায়গায় যেখানে উপাসনালয় রয়েছে, সেখানে একইভাবে প্রতীকী মূল্যে জমি বরাদ্দের দাবি উঠতে পারে।
ধর্মীয় গবেষকরা মনে করেন, রাষ্ট্র যখন সব ধর্মকে সমান সম্মান দেয়, তখন সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে একটি সেক্যুলার কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হতে পারে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রায়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, সেখানে বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে
রেলওয়ের এই জমি বরাদ্দ শুধু একটি প্রশাসনিক কাজ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সামাজিক সংস্কৃতির প্রতীক। মুসলিমদের দুটি মসজিদ ও হিন্দুদের একটি মন্দিরকে প্রতীকী মূল্যে জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে—বাংলাদেশের মাটি কেবল একটি ধর্মের জন্য নয়, বরং সব ধর্মের মানুষের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত।
এটি নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দেবে এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে।