ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
ঝিনাইদহের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লিনা হতে চেয়েছিল শিক্ষক। প্রতিদিনের মতো এক বিকেলে প্রাইভেট পড়া শেষে আর বাড়ি ফেরেনি সে। দুদিন পর ধানক্ষেতের পাশে ঝোপে মিলল তার নিথর দেহ। তদন্তে বেরিয়ে আসে—প্রথমে ধর্ষণ, পরে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় তাকে। হত্যাকারী ছিল তারই প্রতিবেশী, যে দীর্ঘদিন ধরে লিনাকে নানা অজুহাতে হয়রানি করছিল। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ করার কথা ভাবলেও গ্রামের লোকজন বলেছিল—‘এসব প্রকাশ করলে মেয়েরই বদনাম হবে!’
লিনার এই করুণ পরিণতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিনই কন্যাশিশু ও নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কারও ক্ষেত্রে সেই সহিংসতার পরিণতি হত্যায় গড়াচ্ছে। যৌন সহিংসতার এ প্রবণতা এখন আর ব্যতিক্রম নয়, বরং তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে নারী নির্যাতনের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
- এ সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১,৬৬৪ জন নারী ও কন্যাশিশু।
- ধর্ষণের শিকার ২৫৩ জন, এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১০৫ জন।
- ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৫ জনকে।
- যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৮১ জন, এর মধ্যে ১৩৫ জনই কন্যাশিশু।
- ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ছয়জন—যাদের মধ্যে পাঁচজনই কন্যাশিশু।
গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৫১৬ জন, যার মধ্যে ৩৬৭ জন ছিল কন্যাশিশু। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৪২ জন এবং ২৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১,৭৯০ নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪০৫টি ধর্ষণ, ১১৭টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ১৮টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
আলোচিত কয়েকটি ঘটনা
- মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা
- কুমিল্লার মুরাদনগরে নারীকে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ময়নাকে ধর্ষণ ও হত্যা
- ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে নারী নিপীড়ন
- রংপুরে ফুল তুলতে যাওয়া শিশুকে ধর্ষণ
- নাটোরে ঘাস কাটতে গিয়ে আদিবাসী শিশুকে ধর্ষণ
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে আপত্তিকর মন্তব্য ও ফুটবল খেলার মাঠে হামলা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ধর্ষণ মামলার সঠিক তদন্ত ও দ্রুত বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা দুঃসাহসী হয়ে উঠছে। ২০২০ সালে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হলেও এর কার্যকর প্রভাব সমাজে দেখা যায়নি। সামাজিক লজ্জা ও অপমানের ভয়, মামলার জটিল প্রক্রিয়া, পুলিশি হয়রানি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভুক্তভোগীদের মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করছে।
আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের (উই ক্যান) প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন—
“আগে বলা হতো দেশে আইনের শাসন নেই, এখন বলা হয় আইনের শাসনের প্রয়োগ নেই। মানুষ এখন তাৎক্ষণিক বিচার চাইছে, ফলে মব জাস্টিস বেড়েছে। এতে প্রকৃত অপরাধী রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, যে কোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।”
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই কার্যকর আইন প্রয়োগ, দ্রুত বিচার ও সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার এই ভয়াবহ প্রবণতা থামানো কঠিন হয়ে উঠবে।