ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে পীর সাহেব চরমোনাইয়ের হুঁশিয়ারি
কুমিল্লার হোমনায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল গণসমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের মানুষ অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাসন প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের সেই শাসন থেকে মানুষ শুধু হতাশা, বিভাজন ও রক্তপাত পেয়েছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন, “আমরা চাই না আমাদের সন্তানদের মরদেহ আর দেখতে। দেশের মানুষকে আর ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো যাবে না।”
গতকাল সোমবার (২৫ আগস্ট) বিকেলে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার দড়িচর মাঠে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত হয় এই গণসমাবেশ। সমাবেশস্থল ছিল জনসমুদ্রে পরিণত, যেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজারো মানুষ উপস্থিত হন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি আসন্ন নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনের শক্তি প্রদর্শনের অন্যতম বড় আয়োজন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আয়োজক কমিটির সভাপতি মাওলানা তফাজ্জল হুসাইন এবং সঞ্চালনায় ছিলেন মুহাম্মদ ইউসুফ। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।
নিজের বক্তব্যে পীর সাহেব চরমোনাই দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,
“ইতিমধ্যে সামনে কী হতে পারে তা অনুমান করা যাচ্ছে। চাঁদার জন্য মানুষকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে এবং লাশের ওপর নৃত্য করতে দেখেছি। নির্বাচন কমিশনে গিয়ে মারামারির ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বও লক্ষ্য করা গেছে। তাই পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতি ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দেশে বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ বলে মনে করছে।
সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারাও বক্তব্য রাখেন।
- মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বলেন—দেশে সুশাসন ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকে ইসলামী আন্দোলনের পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
- ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, যুগ্ম মহাসচিব, জোর দিয়ে বলেন—জনগণ আর ভোট ডাকাতি ও প্রহসনের নির্বাচন চায় না।
- মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম, সহকারী মহাসচিব, বলেন—রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের একমাত্র পথ হলো ইসলামী আন্দোলনের বিকল্প নেতৃত্বকে গ্রহণ করা।
- মাওলানা তাজুল ইসলাম (কুমিল্লা পশ্চিম জেলা শাখার সভাপতি) বলেন—কুমিল্লা অঞ্চলে ইসলামী আন্দোলন একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে এবং জনগণ পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে।
- মাওলানা বশির আহমদ, জেলা মুজাহিদ কমিটির সভাপতি, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেন।
গণসমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারাও বক্তব্য রাখেন। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে আসন্ন নির্বাচনে ভিন্নমতাবলম্বী ইসলামী দলগুলোও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমর্থনের পথ খুঁজছে।
- নাজিম উদ্দিন মোল্লা, জামায়াতের মনোনীত কুমিল্লা-২ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী, বলেন—জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী আন্দোলনের সাথে তাদের সমন্বয় থাকবে।
- মাওলানা সাইদুল হক, হোমনা উপজেলা জামায়াতের আমির, বলেন—রাজনীতির মূলে যদি নৈতিকতা না থাকে, তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়।
- হাফেজ মাওলানা মো. ইব্রাহিম, হেফাজতে ইসলামের হোমনা উপজেলা শাখার সেক্রেটারি, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
- রহমত উল্লাস আশেকী, হোমনা পৌর শাখার সভাপতি, জনগণের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন।
- মাওলানা শাহ আলম, ঘাগুটিয়া ইউনিয়নের সভাপতি, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন।
- সাইদ আহমেদ সরকার, তিতাস উপজেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির সভাপতি, বলেন—জনগণ ধোঁকা ও প্রহসনের রাজনীতি থেকে মুক্তি চায়।
সমাবেশের শেষপর্বে কুমিল্লা-১ এবং কুমিল্লা-২ আসনের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থীদের জনসমক্ষে পরিচয় করিয়ে দেন পীর সাহেব চরমোনাই। এতে উপস্থিত জনতার মধ্যে উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
এই গণসমাবেশ শুধু ইসলামী আন্দোলনের শক্তি প্রদর্শন নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে,
- পীর সাহেব চরমোনাই নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন ধারা তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
- দেশের মানুষ অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বিভ্রান্ত নয়, বরং নতুন নেতৃত্ব ও বিকল্প রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম খুঁজছে।
- ইসলামী আন্দোলনের সাথে অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সমন্বয় আসন্ন নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
- পিআর পদ্ধতির দাবিটি ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কারের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
সমাবেশে উপস্থিত সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই বলছেন, তারা আর রক্তপাত ও বিভাজন চান না। তারা এমন নেতৃত্ব খুঁজছেন, যারা সৎ, নিরপেক্ষ এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
কুমিল্লার হোমনায় অনুষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এই গণসমাবেশ আসন্ন জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি বড় বার্তা। পীর সাহেব চরমোনাইয়ের বক্তব্য এবং নেতাদের সমন্বিত অবস্থান প্রমাণ করে, তারা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ধরনের বার্তা ভবিষ্যতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।