প্রথম চালানে ১৫ মেট্রিক টন প্রবেশ, খুচরা বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে
বাংলাদেশের ভোক্তা সাধারণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় অন্যতম হলো পেঁয়াজ। এই এক খণ্ড সবজিকে কেন্দ্র করে দেশের বাজারে বহুবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা, মজুতদার সিন্ডিকেট এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি মিলিয়ে বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য পেঁয়াজ বারবার হয়ে উঠেছে দুঃশ্চিন্তার কারণ। দীর্ঘ আড়াই বছরের বিরতির পর অবশেষে ভারত থেকে আবারও পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। সোমবার (২৫ আগস্ট) রাতের বেলায় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম চালানে ১৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ প্রবেশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে বাজারে স্বস্তির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
প্রথম চালানটি আমদানি করেছে বাগেরহাটের প্রতিষ্ঠান এস এম ওয়েল ট্রেডার্স। অপরদিকে রপ্তানি করেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন। বেনাপোল স্থলবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপ-সহকারী কর্মকর্তা শ্যামল কুমার নাথ গণমাধ্যমকে জানান, যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রথম চালান ছাড়ের অনুমতি দেওয়া হয়।
প্রতি মেট্রিক টনের দাম ধরা হয়েছে ৩০৫ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৭ হাজার ৪২৯ টাকা। হিসাব অনুযায়ী, কেজিপ্রতি পাইকারি বাজারদর দাঁড়াচ্ছে ৫৮-৬০ টাকা। আর বাজারে প্রবেশের পর খুচরা দামে ইতোমধ্যেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সোমবার যেখানে কেজিপ্রতি ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, মঙ্গলবার দাম নেমে এসেছে ৬২-৬৫ টাকায়।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৭-২৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৪ সালে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৩২ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ কাগজে-কলমে দেখা যাচ্ছে, চাহিদার তুলনায় ৪-৫ লাখ টন অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাজারে সেই সরবরাহ পৌঁছায়নি। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের কারণে কার্যকর ঘাটতি তৈরি হয়, ফলে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
বেনাপোল বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা ক্রেতা সিহাব উদ্দিন বলেন,
“আজ এসে দেখি পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। এত দিন যে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানো হয়েছিল, তা এখন স্পষ্ট।”
আরেক ক্রেতা রাজিয়া সুলতানা জানান,
“এক মাস আগেও ৫০ টাকায় পেঁয়াজ কিনতাম, পরে সেটা ৭০ টাকায় পৌঁছায়। এখন যদি নিয়মিত আমদানি হয় আর দাম ৫০-৫৫ টাকায় নামে, তাহলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবার স্বস্তি পাবে।
খুচরা বিক্রেতা আবু জর বলেন,
“দাম বেশি থাকলে ক্রেতাদের সঙ্গে ঝামেলা হয়, আবার সরবরাহ কম থাকলে পণ্য রাখা যায় না। আমদানি শুরু হওয়ায় বাজারে চাপ স্বাভাবিক হবে।”
অন্যদিকে পাইকারি বিক্রেতা আব্দুল জব্বার বলেন,
“কিছু ব্যবসায়ী মজুদ করে দাম বাড়িয়েছেন। তবে ভারত থেকে মাল আসা শুরু করায় পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ৬-৭ টাকা কমে গেছে। আশা করি, সামনে আরো কমবে।”
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান,
“দেশীয় কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় এতদিন আমদানি বন্ধ ছিল। কিন্তু বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার বাধ্য হয়ে আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এতে বাজারে স্থিতি ফিরবে।”
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক মো. শামীম হোসেন বলেন,
“আড়াই বছর পর আবারও পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলো। প্রথম চালান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ছাড় করা হয়েছে। আমরা দ্রুত সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছি। আগামী দিনে আরো বড় চালান এলে তা সামলানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে।”
বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাজার দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে অস্থির হয়ে থাকে। পেঁয়াজ এর একটি বড় উদাহরণ। যখন দেশীয় উৎপাদন ভালো হয়, তখনও অজুহাত তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য অস্থিরতা দেখা দিলেও অস্বাভাবিকভাবে দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই অবস্থায় আমদানি শুরু হলে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সুশাসন ও তদারকি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ সপ্তাহেই ধাপে ধাপে আরও কয়েকশ’ টন পেঁয়াজ দেশে প্রবেশ করবে। সেপ্টেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে বড় চালান আসার প্রত্যাশা রয়েছে। এর ফলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে এবং দাম আরও কমে আসতে পারে।
দেশে যখন পেঁয়াজের উৎপাদন হয়, তখন কৃষকরা প্রায়ই ন্যায্যমূল্য পান না। অনেক সময় লোকসান দিয়ে ফসল বিক্রি করতে হয়। আবার বাজারে ঘাটতি তৈরি হলে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ফলে ভারসাম্য বজায় রাখতে কৃষকের সুরক্ষা এবং ভোক্তার স্বস্তি – উভয়কে গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন জরুরি।
আড়াই বছরের বিরতির পর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ায় বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রথম চালান আসার পরপরই খুচরা ও পাইকারি দামে কিছুটা কমতি লক্ষ্য করা গেছে। যদি ধারাবাহিকভাবে আমদানি অব্যাহত থাকে, তবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এটি স্বস্তির হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সিন্ডিকেট ভাঙা, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং নিয়মিত সরবরাহ বজায় রাখা।