প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে রাজধানীতে উত্তাল শাহবাগ
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে অচল হয়ে পড়ে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। ‘ব্লকেড অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ শিরোনামে ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে তিন দফা দাবি জানান। ফলে ওই এলাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মূল কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদ। শুধু তাই নয়, তারা আরও কিছু দাবিও উত্থাপন করেন, যা প্রকৌশলী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দেশের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এখানে পড়াশোনা শেষ করে বের হওয়া প্রকৌশলীরা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি বুয়েটের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনকে হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনা প্রকৌশলী মহলে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।
ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার বুয়েট শিক্ষার্থীরা ‘ব্লকেড অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঘোষণার পরদিন মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তারা শাহবাগ মোড়ে সমবেত হয়ে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন।
শাহবাগ অবরোধে অংশ নেওয়া বুয়েট শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। সেগুলো হলো—
১. প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনকে হত্যার হুমকি প্রদানকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় আনা।
২. প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন।
৩. দেশের উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে প্রকৌশলীদের মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, এই তিন দফা দাবি মানা না হলে তারা আরও কঠোর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন।
বিকেল থেকেই শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে সমবেত হয়ে ব্যানার-ফেস্টুন হাতে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা ব্যারিকেড তৈরি করে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। ফলে শাহবাগ থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, কাকরাইল, মৎসভবন, বাংলা মোটর, সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত তীব্র যানজট তৈরি হয়।
যানজটে আটকে থাকা যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হঠাৎ অবরোধে তারা ভীষণ ভোগান্তিতে পড়েছেন। তবে একইসঙ্গে অনেকে আন্দোলনের যৌক্তিকতাও মেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি মানার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে একটানা স্লোগান দিতে থাকেন—
- “প্রকৌশলীর রক্ত বৃথা যেতে দেব না।”
- “রোকনের নিরাপত্তা চাই, হত্যার হুমকি বরদাস্ত হবে না।”
- “প্রকৌশলীর মর্যাদা রক্ষায় এক হও।”
অনেক শিক্ষার্থী প্ল্যাকার্ড হাতে লিখে এনেছিলেন, “Engineer’s Life Matters”, “Justice for Rokon”, “Protect Our Engineers” ইত্যাদি।
তাদের দাবি, প্রকৌশলীরা দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখলেও নানা সময় অবহেলার শিকার হন। রাষ্ট্র যদি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, তাহলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
শাহবাগ অবরোধের সময় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন—
“শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো যৌক্তিক। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে অবরোধ না করার জন্যও অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”
শিক্ষার্থীরা জানান, প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনের বিরুদ্ধে দেওয়া হুমকি কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, পুরো প্রকৌশলী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হুমকি।
একজন শিক্ষার্থী বলেন—
“রোকনের মতো একজন প্রাক্তন বুয়েটিয়ান যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তবে আমরা সকলে ঝুঁকির মধ্যে আছি। তাই এই হুমকি আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না।”
আরেকজন বলেন—
“আমাদের দাবি মানতে হবে। না হলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে। শাহবাগ থেকে সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে যাবে।”
শাহবাগ অবরোধের ফলে অনেক সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও তারা শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এক যাত্রী বলেন—
“হঠাৎ অবরোধে আমি হাসপাতালে যেতে পারছি না, এতে ভোগান্তি হচ্ছে। তবে আমি বুঝতে পারছি, ওদের দাবি যৌক্তিক।”
একজন পথচারী বলেন—
“প্রকৌশলীরা দেশের উন্নয়ন করেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিক।”
বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ফেসবুক ও টুইটারে অনেকে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে পোস্ট করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা যদি তাদের দাবি আদায় করতে না পারেন, তবে তা ভবিষ্যতে আরও বড় আন্দোলনে রূপ নিতে পারে। আবার সরকার দ্রুত উদ্যোগ নিলে সমস্যার সমাধানও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণ করতে হবে।
১. প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনকে হত্যার হুমকিদাতাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা।
২. প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন।
৩. শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা।
৪. ভবিষ্যতে প্রকৌশলী ও পেশাজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো।
শাহবাগে বুয়েট শিক্ষার্থীদের অবরোধ বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। ‘ব্লকেড অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা শুধু একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার দাবিই তুলেননি, বরং প্রকৌশলী সম্প্রদায়ের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার কথাও বলেছেন।
সরকার যদি দ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে পরিস্থিতি শান্ত হতে পারে। অন্যথায় এই আন্দোলন আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করবে এবং দেশের প্রকৌশলী সমাজ একত্রিত হয়ে বড় ধরনের গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
শিক্ষার্থীদের দাবির সুরাহা করা এখন সময়ের দাবি—যাতে দেশের উন্নয়ন যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রকৌশলীরা নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।