কাঙ্ক্ষিত ইলিশ বাজারে এলেও দাম আকাশচুম্বী, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু দেশের অর্থনীতির জন্য নয়, সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও আনন্দঘন মুহূর্তের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশ পাওয়া গেলেও এর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগরের মেঘনা নদীতে আবারও রুপালি ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়তে শুরু করেছে। এ খবরে স্থানীয় জেলেদের মুখে হাসি ফুটলেও বাজারে ইলিশের দাম এখনো সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের অনেক বাইরে।
আড়াই মাসেরও বেশি সময় নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা মেলেনি। বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক নানা কারণে জেলেরা দীর্ঘ সময় ধরে হতাশায় ছিলেন। তবে চলতি সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্টে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করেছে। রামগতি উপজেলার টাংকিবাজার, আলেকজান্ডার, রামগতি বাজার ঘাট, কমলনগরের মতিরহাট, লুধুয়া ও মাতাব্বরহাট ঘাটে প্রতিদিন কয়েক টন করে ইলিশ ধরা পড়ছে।
জেলেরা জানিয়েছেন,
- টাংকিবাজার মাছঘাটে প্রতিদিন ধরা পড়ছে গড়ে ৮-১০ টন ইলিশ।
- আলেকজান্ডার ঘাটে উঠছে ৬ থেকে সাড়ে ৬ টন।
- রামগতি বাজার ঘাটে ৬-৭ টন।
- মতিরহাট ঘাটে প্রতিদিন ৩-৪ টন।
- লুধুয়া ঘাটে ২-৩ টন।
- আর মাতাব্বরহাট ঘাটে আড়াই টনের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে।
এই পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ার ফলে স্থানীয় জেলেরা অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না।
জেলেরা যখন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত ইলিশ জালে তুলছেন, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই বাজারে দাম কিছুটা কমার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশের দাম এখনো আকাশছোঁয়া।
বর্তমানে—
- এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায়।
- ৬০০-৮০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকায়।
- ৩০০-৪০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকায়।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, এত ইলিশ নদীতে ধরা পড়লেও বাজারে দামের লাগাম নেই। অনেকেই শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছেন বা অন্য প্রজাতির মাছ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
সিন্ডিকেটের দাপট
দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে মাছঘাটে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্রে আড়তদার, দাদন ব্যবসায়ী ও মাছঘাট কমিটি সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
জেলেদের অভিযোগ—
- সারা দিন নদীতে কষ্ট করে ইলিশ ধরার পর ঘাটে এসে তারা ন্যায্য দাম পান না।
- সিন্ডিকেট আগে থেকেই দাম ঠিক করে রাখে।
- সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে রাখতে ইলিশ পাইকারি মোকামে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
- প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এ সিন্ডিকেট চক্র।
এমন পরিস্থিতিতে জেলেরা অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ছেন।
সাধারণ ক্রেতা ও জেলেরা মনে করেন, স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের দুর্বল নজরদারি এই অস্থিরতার জন্য দায়ী। যদি কার্যকর তদারকি থাকত, তবে সিন্ডিকেট এতটা বেপরোয়া হতে পারত না।
কমলনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুর্য সাহা বলেছেন—
“ইলিশের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা মাছঘাটগুলো পরিদর্শন করব। যদি কোনো সিন্ডিকেট পাওয়া যায়, অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে রামগতি উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সৌরভ-উজ-জামান জানান—
“নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। তবে কিছু চক্র ইলিশ নিয়ে কারসাজি করছে বলে খবর পাচ্ছি। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।”
রামগতি ও কমলনগরের জেলেরা আশাবাদী যে আগামী সপ্তাহগুলোতে ইলিশ আরও বেশি ধরা পড়বে। তখন হয়তো বাজারে সরবরাহ বেড়ে দাম কমতে পারে। তবে সিন্ডিকেট ভাঙা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে তারা মনে করছেন।
কমলনগরের নাজিরগঞ্জ মাছঘাটের জেলে হোসেন আহমদ বলেন—
“আমরা সম্পূর্ণ নদীর ওপর নির্ভরশীল। এখন ইলিশ কিছুটা ধরা পড়ছে। আশা করি আগামী সপ্তাহে প্রচুর মাছ পাব, তখন দামও কমে আসবে।”
রামগতি বাজারের মাছ ব্যবসায়ী নিজাম মাঝি জানান—
“মাছ এখন ধরা পড়ছে, ভালো লাগছে। দামও কমবে আশা করি। তবে সিন্ডিকেট না ভাঙলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না।”
বাংলাদেশে প্রতিবছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়টাকেই ইলিশ মৌসুম বলা হয়। এই সময়ে দেশজুড়ে ইলিশের জোগান বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষও সাশ্রয়ী দামে মাছ কিনতে পারেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের দাপটে এখন ভরা মৌসুমেও দাম কমছে না। এতে জাতীয় মাছ হিসেবে ইলিশের প্রাপ্যতা সাধারণ মানুষের জন্য যেন বিলাসিতায় পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে ইলিশ রপ্তানি থেকেও বাংলাদেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। তবে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের আগে রপ্তানি বাড়ানো উচিত নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সিন্ডিকেট ভাঙা, জেলেদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা এবং বাজারে সঠিক পর্যবেক্ষণ বজায় রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশাসন যদি কঠোর অবস্থান নেয়, তবে জেলে ও সাধারণ মানুষ উভয়ই উপকৃত হবেন।
- প্রতিটি মাছঘাটে সরকারি তদারকি জোরদার করা।
- সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা।
- আড়তদার ও দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা।
- জেলেদের সরাসরি খুচরা বাজারে মাছ বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি।
- ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন।
রামগতি-কমলনগরের মেঘনায় ইলিশ ধরা পড়া শুরু হওয়ায় জেলেদের মুখে হাসি ফিরেছে। কিন্তু সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি ও প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির কারণে সাধারণ মানুষ এখনো ইলিশের স্বাদ নিতে পারছেন না। জাতীয় মাছের বাজারকে সবার নাগালের ভেতরে আনতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। না হলে ভবিষ্যতে ইলিশ হয়তো শুধু ধনীদের জন্য বিলাসী খাবারে পরিণত হবে, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।