বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানকে শোকজের জবাবের জন্য আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দিল দল
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে ঘিরে চলমান বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান সম্প্রতি ওই আন্দোলন নিয়ে ‘কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’ মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ তুলে দল থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। প্রথমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হলেও, পরে তার অনুরোধ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপি তাকে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছে। সোমবার (২৫ আগস্ট) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
রোববার (২৪ আগস্ট) বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে ফজলুর রহমানকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়। অভিযোগ করা হয়, তিনি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছেন যা দলীয় অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই ধরনের মন্তব্য দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী এবং আন্দোলনের গতিপথকে প্রভাবিত করতে পারে।
শোকজ নোটিশ পাওয়ার পরদিন (২৫ আগস্ট) এক ব্রিফিংয়ে ফজলুর রহমান বলেন—
“আমি নির্দিষ্ট সময়ে আমার উত্তর দলকে দেব। আমার দল আমার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি মাথা পেতে তা মেনে নেব। দল আমার চেয়ে বড়। দলীয় শৃঙ্খলা মানা আমার দায়িত্ব।”
এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেন যে, বিএনপির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তকে তিনি চ্যালেঞ্জ করবেন না বরং সেটাকেই মেনে নেবেন। তবে তিনি আবারও দাবি করেন যে, তার বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ফজলুর রহমান প্রথমে সাত দিনের সময় চেয়েছিলেন। তবে বিএনপি শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে এতটা সময় না দিয়ে অতিরিক্ত ২৪ ঘণ্টা দিয়েছে। অর্থাৎ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) রাতের মধ্যে তাকে লিখিত জবাব জমা দিতে হবে। এরপর দলের উচ্চ পর্যায় বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজধানীর সেগুনবাগিচার কনকর্ড টাওয়ারের সামনে কিছু সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ করেছে। তারা দাবি তোলে, তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
এই ঘটনাকে ‘ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন ফজলুর রহমান। তার দাবি, এ ধরনের মব তৈরি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যে কোনো নাগরিককে আইনের বাইরে গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা মব তৈরি করে হয়রানি করা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকি। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন এ ধরনের ঘটনায় নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় মোড় ঘুরানোর ঘটনা। সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই সময়ে ব্যাপক জনসমাগম, বিক্ষোভ এবং রাজপথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়।
তবে এই আন্দোলনকে ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য ও বিশ্লেষণ রাজনীতিতে বিতর্ক উসকে দিয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির ভেতরেই এ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ পাওয়া শুরু করেছে। ফলে দলীয় ঐক্য ও জনমতের কাছে অবস্থান সুস্পষ্ট করা এখন বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে ফজলুর রহমানকে আন্দোলন সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করতে শোনা যায়। যদিও তিনি দাবি করেছেন, ভিডিওটি কাটছাঁট করা এবং বিভ্রান্তিকরভাবে প্রচার করা হয়েছে। তার ভাষায়—
“আমার বক্তব্য পূর্ণাঙ্গভাবে প্রচার করা হলে মানুষ বুঝতে পারবে আমি কোনো কালো শক্তির কথা বলিনি। আমাকে ভুল প্রমাণ করতে পারলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চাইব।”
তবে দলীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, প্রকাশ্য প্ল্যাটফর্মে এমন মন্তব্য আন্দোলনের গতি ব্যাহত করতে পারে। তাই শোকজ নোটিশের মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির জন্য এই শোকজ একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র। দল যদি যথাযথ শৃঙ্খলা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তবে তারা অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। অন্যথায় ভেতরের বিভক্তি আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এক বিশ্লেষণে বলেন, “রাজনৈতিক দলে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়ে বক্তব্য দেওয়া হলে সেটি দলের জন্য ক্ষতিকর। বিএনপি এ ঘটনার মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রতি কতটা দৃঢ়, সেটি প্রমাণ করতে পারবে।”
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে শোকজের জবাব পর্যালোচনা করা হবে। ফজলুর রহমানের জবাব গ্রহণযোগ্য হলে তিনি দায়িত্বে বহাল থাকবেন। তবে তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে দল তাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। শাস্তির ধরন হতে পারে সতর্কবার্তা থেকে শুরু করে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি—যেটি পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ইতোমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। বিএনপির ভেতরে এ ইস্যুতে ভিন্ন সুর দলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফজলুর রহমানকে দেওয়া শোকজের জবাব এবং বিএনপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধু দলীয় রাজনীতিতেই নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথেও প্রভাব ফেলতে পারে।
দলীয় ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যৎ আন্দোলনের সফলতা অনেকটাই নির্ভর করছে এই ঘটনার পরবর্তী ধাপের ওপর। বিএনপি কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে বিষয়টি মোকাবিলা করে, তা-ই এখন রাজনৈতিক মহলে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।