ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঐতিহাসিক শাহ আরেফিন টিলা। ১৩৭ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই টিলা আজ ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। গত এক বছরে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনে মাটির বুক ফাঁপড় করে জায়গায় জায়গায় তৈরি হয়েছে বিশাল গর্ত। আইন থাকার পরও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে গেছে টিলার অস্তিত্ব।
শাহ আরেফিন টিলায় দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীন ৭০০ বছরের ঐতিহাসিক মাজার। গত বছর আগস্টেও এটি ছিল প্রায় ৫০ ফুট উঁচুতে দৃশ্যমান। অথচ মাত্র চার মাসের মাথায় মাজারসহ পুরো টিলা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, টিলাটি এখন একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
১৯৯৫ সালে আইন করে টিলা থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হলেও ১৯৯৯ সালে সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয় শাহ আরেফিন টিলা। এরপর থেকে চলতে থাকে নির্বিচার পাথর লুট। মামলা-মোকদ্দমার কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ফের শুরু হয় দেদারসে পাথর উত্তোলন।
যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানে জানা যায়, টিলা ধ্বংসের নেপথ্যে রয়েছে অন্তত ২০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ লুটপাটে অংশ নিয়েছেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
- বিএনপি নেতাদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাবুল আহমদ বাবুল, ইসলামপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেবুল আহমদ, ৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ইসমাঈল মিয়া প্রমুখ।
- আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে নাম এসেছে উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক হুঁশিয়ার আলী, ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ফয়জুর রহমান, কালাইরাগের দুলাল মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আমিনুল ইসলাম ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শাহাবুদ্দিনের।
- জামায়াত কর্মী ইয়াকুব আলী সরাসরি পাথর পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।
শুধু শাহ আরেফিন টিলা থেকেই লুট হয়েছে শতকোটি টাকার পাথর। ধলাই নদীর দুই তীরে গড়ে তোলা হয় শত শত পাথর রাখার স্থান। ভাড়া, শ্রমিক ভাগ-বাটোয়ারা আর অবৈধ নৌকা বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিদিন সিন্ডিকেট সদস্যরা আয় করেছে কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কিছু সদস্যও এ চক্র থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেছে। যমুনা টেলিভিশনের হাতে এমন ভিডিও ফুটেজও এসেছে।
পাথর লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা বিএনপির স্থগিতকৃত সভাপতি সাহাব উদ্দিন ও যুবদল নেতা সাজ্জাদ দুদুর নাম সামনে আসে। সাহাব উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, তিনি উল্টো লুট ঠেকাতে আন্দোলন করেছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জড়িত নেতারা এখন পলাতক। স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকাকালে টিলা ধ্বংসের পেছনে তারাই ছিল সবচেয়ে সক্রিয়।
অনুসন্ধানে আরও ৫১ জনের নাম উঠে এসেছে, যারা পূর্ব পার ও পশ্চিম পারের জমি দখল করে পাথর ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন জেলা ও উপজেলা যুবদল, ছাত্রদল, যুবলীগ নেতাকর্মীসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে চোখের সামনে এ লুটপাট চললেও প্রশাসন কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। জুলাইয়ের ফুটেজে দেখা যায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই নদী থেকে পাথর তোলা হচ্ছে। অথচ তদন্তের দায়িত্ব এখন তাকেই দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে শাহ আরেফিন টিলা, সাদাপাথর, জাফলং ও রাংপানি থেকে প্রায় ৩ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। উদ্ধার করা গেছে মাত্র ৫ লাখ ঘনফুট, বাকিগুলো ইতোমধ্যেই বিক্রি বা চূর্ণ করে ফেলা হয়েছে।