ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
রাজপথে তখন আর কোনো স্লোগান নয়, ছিল শুধু প্রতিরোধ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন, ৪ আগস্ট—বাংলাদেশ যেন পরিণত হয়েছিল এক রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না করার রিট খারিজ হওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলো। সেদিন ‘জঙ্গি দমন কায়দায়’ চালানো হয় নির্মম দমন-পীড়ন। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন গতি পায় ‘এক দফা’ আন্দোলন।
৪ আগস্ট ভোর থেকেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ধানমন্ডি, উত্তরা, বাড্ডা, প্রগতি সরণি—প্রতিটি এলাকায় শুরু হয় ছাত্র-জনতার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। রাস্তায় নামে শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ। রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গড়ে তোলে মানবপ্রাচীর। কিন্তু সেই প্রাচীর ভেঙে দিয়ে শুরু হয় গুলিবৃষ্টি।
অসুস্থ অবস্থায় ঢাকামেডিকেলে নেয়া হয় গুলিবিদ্ধ ৬৭ জনকে। চিকিৎসা নেন প্রায় আড়াইশোর বেশি আহত মানুষ। শুধু জরুরি বিভাগেই প্রাণ হারান ৭ জন। একেকটি হাসপাতাল যেন পরিণত হয় রক্তে ভেজা যুদ্ধক্ষেত্রে। চিকিৎসক-নার্সরা টানা সেবা দিয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় পৌঁছে যান।
সেদিনই ঘটে ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী ঘটনা—মিরপুরে সরকারপন্থি বাহিনীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন কিছু সেনাসদস্য। আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে ছাত্রলীগ-পুলিশের দিকে ছোড়া হয় ফাঁকা গুলি। এতে সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, কিছু একটা বদলাচ্ছে—অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ছাত্র-জনতার এক দফা আন্দোলন তখন আর নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। ঢাকায় মার্চের ঘোষণা ছিল ৬ আগস্ট, কিন্তু ৪ আগস্ট রাতেই জানিয়ে দেয়া হয়, ‘মার্চ টু ঢাকা’ হবে ৫ আগস্ট। সমন্বয়কারীরা জানান, এটি ছিল একটি কৌশলগত ফাঁদ, যা সরকারের বিপর্যয় ত্বরান্বিত করে।
দেশজুড়ে তখন একটাই বার্তা—‘ডু অর ডাই’। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, দিনাজপুর, ঝিনাইদহসহ সব জায়গায় গড়ে ওঠে শক্ত প্রতিরোধ। সরকারি স্থাপনায় চালানো হয় বিচ্ছিন্ন ভাঙচুর, বিএসএমএমইউ কম্পাউন্ডে অগ্নিসংযোগ, নিম্ন আদালতের মূল গেট ভেঙে অভ্যন্তরে ঢুকে ক্ষোভ প্রকাশ।
চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোতে থাকা সরকারের সর্বশেষ চেষ্টা ছিল ৪ আগস্ট রাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বসেন তার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেখানেই সেনাবাহিনীর ওপর গুলি চালানোর চাপ দেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশ যেন থমকে যায়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় থেকে পটুয়াখালী—সব জায়গার বাতাসে তখন বিদ্রোহের গন্ধ। আর এই গন্ধই যেন বলে দিচ্ছিল, দ্বিতীয় মেয়াদে দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘণ্টা বেজে গেছে।