ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
‘ধান, গরু বিক্রি করে আলু চাষ করেছি। এখন বাজারে আলুর দাম নাই। সরকারের কাছে অনুরোধ, ওএমএস-টিসিবির মাধ্যমে আলু বিক্রি করে আমাদের বাঁচান। পারলে রপ্তানির ব্যবস্থাও করেন।’—এমনই করুণ আকুতি ঠাকুরগাঁওয়ের পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হান্নানের। শুধু তিনিই নন, মুন্সীগঞ্জ, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের আলু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর হাজারো কৃষক একই সমস্যায় কাতর।
অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে বাজারে আলুর দাম কমে যাওয়ায় চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন আলুচাষিরা। অনেকেই জানিয়েছেন, কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন হিমাগার মালিকরাও।
লোকসান কেজিতে ১০ টাকা, বিপাকে কৃষক
সরকারি হিসাবে চলতি মৌসুমে আলুর গড় উৎপাদন খরচ ছিল কেজিতে ১৪ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগারে সংরক্ষণ খরচসহ মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৫ টাকা। অথচ বিভিন্ন জেলায় হিমাগার ফটকে আলু বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকায়, আর খুচরা বাজারে ১৫ থেকে ১৮ টাকা দরে।
ঢাকায় গতকাল আলুর দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। এক বছর আগে একই সময়ে এই দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ফলে এবার লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, বিপরীতে ক্ষতির বোঝা বাড়ছে দিন দিন।
বাজারে ধস, হিমাগারে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রীত
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ) জানিয়েছে, দেশের ৩৫০টির বেশি হিমাগারে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ টন আলু। এর মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হয়তো আর খালাসই হবে না, যা ফেলতে হলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
বিসিএসএ তাদের চিঠিতে হিমাগার ফটকে আলুর ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ, ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) ও টিসিবির মাধ্যমে বিক্রির আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি প্রস্তাব দিয়েছে, সরকারের ভর্তুকির আওতায় ৫৫ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকায় চালের সঙ্গে ১০ কেজি করে আলু সরবরাহ করা যেতে পারে।
মুন্সীগঞ্জে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি
আলুর উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় এতটাই বড় যে, শুধু মুন্সীগঞ্জেই কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ১,২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জেলার বেশিরভাগ কৃষকই বর্তমানে ঋণের বোঝায় জর্জরিত। তাঁরা প্রণোদনা, ঋণ মওকুফ এবং ন্যায্য মূল্যের দাবিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি কমেছে
দুই বছর আগেও আলু রপ্তানিতে বাংলাদেশ ছিল আশাব্যঞ্জক অবস্থানে। কিন্তু ২০২৩ সালে রপ্তানি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৩ হাজার টনে, যা ২০২৪ সালে আরও কমে ১২ হাজার টনে নেমে আসে। যদিও চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৭০ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে, তবুও উদ্বৃত্ত উৎপাদনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।
ভবিষ্যতে আলু চাষে আগ্রহ হারাবেন কৃষক
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম আসাদুজ্জামান সতর্ক করে বলেছেন, ‘এ বছর আলুর দাম না পাওয়ায় আগামীতে কম সংখ্যক চাষি আলু চাষে আগ্রহ দেখাবেন। এর ফলে আগামী বছর বাজারে সরবরাহ কমে গেলে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’
সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা আশার আলো
কৃষি উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ওএমএসের মাধ্যমে আলু বিক্রি এবং কৃষকের বাজারে সরাসরি বিপণনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে কৃষকের উৎপাদিত আলু বিনামূল্যে পরিবহনের ব্যবস্থাও থাকবে।
এদিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, টিসিবির মাধ্যমে আলু বিতরণে ভর্তুকির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত হলে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।