ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের দেশব্যাপী চলা গণবিক্ষোভ দমন করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে এক গোপন ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে উঠে এসেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) এ সংক্রান্ত অডিও রেকর্ড ফাঁস করেছে, যা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ফাঁস হওয়া অডিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (NTMC) কর্তৃক রেকর্ড করা এক ফোনালাপে শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে বলেন,
“আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি একদম। এখন লিথাল ওয়েপনস (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে, সোজা গুলি করবে।”
তিনি আরো বলেন, ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এতদিন তিনি এই সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছিলেন।
একই ফোনালাপে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র এবং আত্মীয় ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভ দমনের বিষয়েও কথা বলেন। তাকে বলতে শোনা যায়,
“যেখানেই গ্যাদারিং দেখবে, সেখানে ওপর থেকে… এখন ওপর থেকে করা হচ্ছে, অলরেডি শুরু হয়ে গেছে কয়েকটা জায়গায়।”
যদিও সরকার তখন হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছিল, তবে ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাবির শরিফ আল-জাজিরাকে জানান,
“আমাদের হাসপাতালের সামনেই হেলিকপ্টার থেকে গুলি এবং টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। আহতদের শরীরে অস্বাভাবিক গুলির ক্ষত ছিল, যা শরীরের ভেতরে থেকেই যাচাই করা হয়।”
এছাড়া রংপুরের এক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এই ঘটনার পর আন্দোলন আরও তীব্র হয় এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গোপন রাখতে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম জানান,
“আমাকে পাঁচবার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলাতে বলা হয়। পুলিশ চেয়েছিল রিপোর্টে লেখা হোক—সাঈদ ইটপাটকেলের আঘাতে মারা গেছেন। কিন্তু তিনি মারা যান পুলিশের গুলিতে।”
গোপনে রেকর্ড হওয়া একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে কড়া ভাষায় জানতে শোনা যায়,
“ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? কে লুকোচুরি খেলছে?”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা, তার সরকারের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করেছে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান,
“তিনি জানতেন, তার ফোন রেকর্ড হচ্ছে। তারপরও তিনি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি যেই গর্ত করেছেন, এখন সেই গর্তেই পড়েছেন।”
আবু সাঈদের মৃত্যুর ১২ দিন পর তার পরিবারসহ ৪০ জন নিহত বিক্ষোভকারীর পরিবারের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই বৈঠক সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেখানে শেখ হাসিনা পরিবারগুলোর হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দেন। তবে সাঈদের বোন সুমি খাতুন সোজাসাপ্টা বলেন,
“ভিডিওতে তো দেখা গেছে পুলিশ গুলি করেছে। এখানে তদন্তের কী আছে?”
আর সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন অভিযোগ করেন, “জোর করে আমাদের গণভবনে আনা হয়েছে। না এলে হয়রানি করা হতো।”
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আল-জাজিরাকে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনা কখনো ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহারের নির্দেশ দেননি। ফোনালাপগুলো কৌশলে সম্পাদিত বা বাছাইকৃত বলে উল্লেখ করা হয়।
তারা আরও দাবি করেন,
“আবু সাঈদের মৃত্যুর তদন্তে সরকার পূর্ণ আন্তরিক।”
এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলেও নড়েচড়ে বসেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। অডিও ফরেনসিক এবং ভয়েস ম্যাচিং বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাই করে আল-জাজিরা নিশ্চিত করেছে—এটি কারসাজিমুক্ত এবং প্রকৃত ফোনালাপ।