ঢাকা | ১৯ জুলাই ২০২৪
চব্বিশের উত্তাল জুলাই আন্দোলনের ১৯ তারিখে সারা দেশে ভয়াবহ রূপ নেয় ছাত্র-জনতার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। এদিনের সংঘর্ষে প্রাণ হারান অন্তত ৩০ জন। ঢাকা পরিণত হয় এক বিভীষিকাময় শহরে—অস্থিরতা, আতঙ্ক আর রক্তের গন্ধে কাঁপে গোটা দেশ। রাত ১২টা থেকে রাজধানীসহ দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে সরকার। একইসঙ্গে ঘোষণা আসে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তের।
সকাল থেকেই উত্তপ্ত ঢাকার রাজপথ। রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেট, কুড়িল, মহাখালী, উত্তরা—প্রতিটি মোড়ে বিক্ষোভ, পুলিশি অ্যাকশন ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় পরিণত হয় এক একটি যুদ্ধক্ষেত্রে।
নির্বিচারে ছোড়া হয় গুলিবর্ষণ, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও ছোড়া হয় গুলি ও টিয়ারশেল।
দিনব্যাপী সবচেয়ে নৃশংস ও প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটে যাত্রাবাড়ীতে, যেখানে শুধু এই এলাকাতেই ৫ জন প্রাণ হারান। পুরো দিনজুড়ে সংঘর্ষ চললেও রাতভর সহিংসতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়, থেমে যায় যান চলাচল।
একইসঙ্গে হামলা চালানো হয় বিটিভি কার্যালয়েও, যেটিকে আন্দোলনকারীরা স্বৈরাচারের মুখপত্র হিসেবে চিহ্নিত করে।
দেশজুড়ে আহত-নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। অনেকেই জীবন তুচ্ছ করে আন্দোলনে যুক্ত হন।
কুড়িলে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে র্যাব হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে।
উত্তরা ও মোহাম্মদপুরে দিনব্যাপী সহিংসতায় আহত হন বহু মানুষ। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ঢামেকে আহতদের ভিড় বাড়ে। নিহতদের মরদেহ একে একে পৌঁছায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
সবচেয়ে বেশি হতাহতের খবর আসে যাত্রাবাড়ী ও মহাখালী এলাকা থেকে। নিউমার্কেটে পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ, গুলশানে বেসরকারি ভবন ভাঙচুর, মহাখালীতে গাড়িতে আগুন—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের তীব্রতা।
সরকার রাত ১২টায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে, পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা। মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত।
গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের জরুরি বৈঠকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান, যারা বিশৃঙ্খলা করছে ও সহায়তা করছে—তাদের কাউকেই ছাড়া হবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেন, “আন্দোলনটি বিএনপি-জামায়াত প্ররোচিত”, যার ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাধ্য হয়েছেন গুলি ও কারফিউর নির্দেশ দিতে।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এই আন্দোলন সরকারের দমননীতি ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে, এখন এটি রূপ নিচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে।”
সকালে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানারে মানববন্ধনে অংশ নেন অনেক অভিভাবক।
তারা অভিযোগ করেন—রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন গুলি ছোড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর, তখন নিরব থাকা যায় না। অনেকেই প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন।