সংবাদ প্রতিবেদন:
ঢাকা, জুলাই ২০২৫:
সরকারি চাকরিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ‘কোটা প্রথা’ বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া একটি অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয়েছে যুগান্তকারী রাজনৈতিক পালাবদলে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শুরু হওয়া এই গণআন্দোলনের চাপেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়—‘বাংলাদেশ 2.0’।
২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারের প্রথম আন্দোলন। ১৯৭২ সালের পর থেকে চালু থাকা একটি বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ‘চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামলে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করেন।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ জুন, সেই বাতিল হওয়া কোটাব্যবস্থা আবারো বহাল করা হয় আদালতের এক রায়ের মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে ফের জেগে ওঠে শিক্ষার্থীরা। শুরু হয় দ্বিতীয় দফার আন্দোলন, যা পরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নাড়া দিয়ে যায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানান, “আমরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করলাম যে, এবার জোরালো প্রতিক্রিয়া দিতে হবে। এরপর থেকেই শুরু হয় কর্মসূচির প্রস্তুতি।”
ছাত্ররা সরকারের কাছে ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেয়। এরপর ১ জুলাই থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় ধারাবাহিক কর্মসূচি। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে মিছিল বের হয়ে রাজু ভাস্কর্যে পৌঁছে। সেখানেই ঘোষিত হয় তিন দিনের কর্মসূচি।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের সিদ্ধান্ত হয় ২৮-২৯ জুনের মধ্যে। ছাত্রনেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, “আমরা ১ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিই। সেটি মুহূর্তেই দেশজুড়ে সাড়া ফেলে।”
একই দিনে ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। জগন্নাথ, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের ঢেউ।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আরও গতি আসে শিক্ষক পেনশন স্কিম বাতিল হওয়ার পর। এতে শিক্ষকরাও অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের সংগঠক সারজিস আলম জানান, “১ জুলাইয়ের কর্মসূচিতে আমরা যে বিপুল জনসমাগম দেখি, তাতে ছাত্রদের মনোবল বেড়ে যায়। এই ঐক্যই পরবর্তীতে আন্দোলনকে রূপ দেয় গণআন্দোলনে।”
একইসঙ্গে আন্দোলনের ভাষাগত দিকেও আসে নতুনত্ব। জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “আমরা বিরাজনীতিকরণের সময় পার করেছি। ফলে এমন ভাষা ও বার্তা বেছে নিয়েছি যা রাজনীতিবিমুখ মানুষকেও আকৃষ্ট করে।”
একসময় এই ছাত্র-আন্দোলন এতটাই বেগবান হয় যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ক্রমাগত চাপ ও গণআন্দোলনের মুখে তিনি ৫ আগস্ট দেশত্যাগে বাধ্য হন। এরপর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের—যা ‘বাংলাদেশ 2.0’ নামে পরিচিত।
এই ছাত্র আন্দোলন একদিকে যেমন বৈষম্যবিরোধী সচেতনতা তৈরি করেছে, তেমনি প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য সংগঠিত ছাত্রসমাজ কখনোই পরাজিত হয় না।