অন্তর্বর্তী সংকটে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান: জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অনিশ্চিত ও উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছে জাতি। নির্বাচনের সময়সীমা ঘনিয়ে আসছে, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের অভাব, আস্থার সংকট ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিতর্কিত অবস্থান জাতীয় রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে। সম্প্রতি দলটির নির্বাহী পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—সরকারকে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানানো হবে, যাতে বর্তমান সংকটের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাধান বেরিয়ে আসে।
জামায়াতে ইসলামী দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবে অতীতে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকার জন্য আলোচিত হয়ে এসেছে। তবে চলমান পরিস্থিতিতে দলটি তাদের কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করে সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম—নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখান থেকে সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন অবিলম্বে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়।
এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের আমির শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরসহ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে একটি লিখিত বিবৃতি প্রস্তুত করা হয়, যেখানে বলা হয়—“দেশে একটি টেকসই ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে হলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সর্বদলীয় বৈঠক এখন সময়ের দাবি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে দেশে চলমান অনিশ্চয়তা শুধু রাজনৈতিক পরিবেশ নয়, বরং অর্থনীতি, প্রশাসন ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো—বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত—চাপ প্রয়োগ করছে নির্বাচনী রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণার জন্য। এই অবস্থায় সংলাপ ও সর্বদলীয় বৈঠকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সংলাপ এখন প্রয়োজন নয়—এটি একমাত্র সমাধানের পথ। কারণ রাজনৈতিক সমস্যা কখনো প্রশাসনিক বা নিরাপত্তামূলকভাবে সমাধান সম্ভব নয়।” জামায়াতের সাম্প্রতিক আহ্বান এই বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন চললেও, তিনি এখনও তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের কার্যক্রমে নিরপেক্ষতার অভাব তুলে ধরা হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী এই ব্যাপারে সরাসরি বক্তব্য দিয়েছে। দলের নায়েবে আমির তাহের বলেন, “জনগণ আশা করেছিল একটি নিরপেক্ষ সরকার সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেবে। কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে আমরা উদ্বিগ্ন।” তার মতে, সরকার যদি সর্বদলীয় আলোচনায় বসে তাহলে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসা সম্ভব।
একই দিন বিএনপির পক্ষ থেকেও অনুরূপ বক্তব্য এসেছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমরা একাধিকবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি যেন নিরপেক্ষতার নীতি মেনে চলা হয়। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।” এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াত যেহেতু একই সময় একই ধরণের বক্তব্য দিচ্ছে, এর মাধ্যমে একটি যৌথ অবস্থান তৈরি হতে পারে। এটি সরকারকে একটি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক চাপে ফেলতে পারে।
যদি সরকার সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করে, তাহলে সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে থাকবে:
- অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ
- নির্বাচনের সময়সূচি ও রোডম্যাপ নির্ধারণ
- সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহারের নীতিমালা
- রাজনৈতিক মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারে গঠিত কমিশন
- বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতকরণ
পূর্বে অনেক সময় জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশল কঠোর অবস্থান ও ধর্মীয় ব্যাখ্যাভিত্তিক ছিল। কিন্তু বর্তমানে তারা যে ধরনের সংলাপমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছে, সেটি তাদের নতুন কৌশলের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জামায়াতের এই কৌশল গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা চাই দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ও গণতন্ত্রের ধারা বজায় থাকুক। এজন্য আমরা সংলাপকেই সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছি।”
সরকারের পক্ষ থেকে এখনও সর্বদলীয় বৈঠক সংক্রান্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সরকারও চায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরুক। সর্বদলীয় আলোচনার বিষয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে।” তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা পরিষদের ওপর নির্ভর করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সর্বদলীয় বৈঠক বাস্তবায়ন হয় এবং তাতে কার্যকর আলোচনা হয়, তাহলে এর মাধ্যমে যে সুফলগুলো পাওয়া যাবে তা হলো:
- রাজনৈতিক সহিংসতা হ্রাস পাবে
- নির্বাচনী গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে
- বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আস্থা বাড়বে
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে
এছাড়াও, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার একটি যৌথ প্রত্যাশা—দেশের নেতৃত্ব এখন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিক যা সংকট থেকে জাতিকে মুক্তি দেবে।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তার প্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীর সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। এটি যদি সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলও গঠনমূলকভাবে অংশগ্রহণ করে, তাহলে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের একটি বাস্তব ও টেকসই পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
জনগণের প্রত্যাশা—রাজনীতি হোক সমঝোতার, সংঘাতের নয়। আর এই সমঝোতার প্রথম ধাপ হতে পারে একটি সর্বদলীয় বৈঠক, যেখানে ভিন্নমত নয়, মিলনের পথ খোঁজা হবে।