বিএনপি-জামায়াতসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে অস্থিরতা নিরসনের চেষ্টা
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাব্য পদত্যাগ নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই উত্তেজনা কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ না থেকে জনগণ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে যখন নির্বাচনের সময়সীমা দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং দেশব্যাপী গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষতার দাবিতে চাপ বাড়ছে।
গত বছরের শেষ প্রান্তিকে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসন ও একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের পথ সুগম করার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, এই সরকারের নিরপেক্ষতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন বাড়তে শুরু করেছে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, বিশেষত প্রশাসনিক নিয়োগ, বাজেট ব্যয় এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা—সব কিছুতেই রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে।
এই পরিস্থিতিতে যখন অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন ছড়িয়েছে, তখন তা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কারণ, তিনি কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নন, বরং একাধারে একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের এক মুখপাত্র।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে শুক্রবার রাত থেকেই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের মধ্যে পর্যালোচনা শুরু হয়। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল: অধ্যাপক ইউনূস যদি সত্যিই পদত্যাগ করেন, তাহলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ কী হবে এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতার রূপরেখা কেমন হবে?
এই প্রেক্ষাপটেই শনিবার সন্ধ্যায় একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিএনপি এবং সাড়ে ৮টায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দল সেখানে উপস্থিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপির পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অন্যদিকে, জামায়াতের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির আমির শফিকুর রহমান।
বৈঠকের মূল লক্ষ্য—প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ জানানো এবং একটি সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানানো। বিএনপি ও জামায়াত উভয়েই মনে করছে, বর্তমান সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। একইসঙ্গে, তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাবে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে। তাদের দাবি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেন নিজের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করে।
বিএনপি এখন স্পষ্ট ভাষায় বলছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ২০২৫ সালের মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের রোডম্যাপ প্রকাশ করতে হবে। গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ড. মোশাররফ বলেন, “চাপের মুখে নয়, বরং জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সরকার নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে জনগণ তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে। এর দায় পুরোপুরি সরকারের ওপর বর্তায়।”
গত কয়েক মাসে সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠেছে—এই সরকার আদৌ নিরপেক্ষ কি না? বিশেষ করে প্রশাসনিক পদে একতরফা নিয়োগ, নাগরিক অধিকার খর্ব করা এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের ইত্যাদি বিষয়ে জনগণের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গড়ে উঠলেও, এখন তাতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মনে করছে, এই সরকার যদি নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তবে জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
আজ শনিবার অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সভা শেষে কোনো সংবাদ ব্রিফিং হবে না বলে আগেই জানানো হয়েছে, তবে ধারণা করা হচ্ছে—সভা শেষে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস শুক্রবার সারাদিন সরকারি বাসভবন যমুনায় অবস্থান করেছেন। এর মধ্যে তিনি কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য না করলেও, তাঁর নীরবতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক আয়োজন—দুটিই ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি গভীরভাবে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের পদত্যাগের সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক মহলেও গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার একটি ‘ট্রানজিশনাল অথরিটি’ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে ছিল। এখন যদি তিনি পদত্যাগ করেন, তবে সেই আস্থা অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই মুহূর্তে ড. ইউনূসের সিদ্ধান্ত শুধু একটি ব্যক্তির পদত্যাগ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতার মাধ্যমে একমত হয় এবং প্রধান উপদেষ্টা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আস্থা ফিরে পান, তবে নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত হতে পারে। অন্যথায়, একটি নতুন সংকটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে দেশ।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি সঠিক সিদ্ধান্ত পুরো জাতিকে স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যেতে পারে, আবার একটি ভুল সিদ্ধান্ত নয়া সংকটের দ্বার খুলে দিতে পারে। এই মুহূর্তে অধ্যাপক ড. ইউনূসের কাঁধে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব। তিনি কী করবেন, তা জানতে তাকিয়ে রয়েছে গোটা জাতি।