বগুড়ায় জুলাই আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের পাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শিক্ষার্থী আন্দোলন বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। দেশের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। বিগত জুলাই মাসে বগুড়ায় সংঘটিত একটি শিক্ষার্থী আন্দোলন কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা শুধু স্থানীয় নয়, বরং জাতীয় পর্যায়েও আলোচনার জন্ম দেয়। সেই আন্দোলনে আহত হয় একাধিক ছাত্র-ছাত্রী। এই আহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি – বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাদের এই মানবিক ভূমিকা সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসার সৃষ্টি করেছে।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে বগুড়ায় ঘটে যাওয়া এই আন্দোলনটি মূলত শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক পরিবর্তনের বিরোধিতায় শুরু হয়েছিল। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে শিক্ষার্থীরা একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল আয়োজন করে। তাদের প্রধান দাবি ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ন্যায্য ভর্তি ফি নির্ধারণ, পরীক্ষা পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, এবং ছাত্রকল্যাণ তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
প্রথমদিকে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু কয়েকদিনের মাথায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং কিছু উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন শিক্ষার্থী আহত হন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা ছিল গুরুতর।
আহত শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই স্থানীয় স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। এদের মধ্যে কেউ কেউ হাটহাজারী কলেজ, কেউ আবার বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার সময় তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। তারা কেবল শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য তাদের গুণতে হয় চরম মূল্য।
আহতদের মধ্যে রায়হান হোসেন, মেহেদী হাসান, তাসফিয়া সুলতানা, তানভীর আলম, আফরিন নাহারসহ অনেকে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়িতে অবস্থান করছেন, আবার কেউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তাঁদের সবার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
আন্দোলনের এই করুণ ঘটনার প্রায় এক মাস পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল সরাসরি ওই আহত শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা শুধু তাদের শারীরিক অবস্থা জানতেই যাননি, বরং পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন একজন অভিভাবকের মতো।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আহত শিক্ষার্থীদের মাঝে ওষুধ, পুষ্টিকর খাবার ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্ত করা হয় যে, তাদের সন্তানরা একা নয়। রাষ্ট্র এবং জাতি তাঁদের পাশে আছে।
সেনাবাহিনীর এই কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজকল্যাণ অফিসারসহ মোট ১২ সদস্যের একটি দল সরেজমিনে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম বলেন,
“এই দেশের ভবিষ্যৎ আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তারা যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, সে জন্যই আমরা তাদের পাশে এসেছি। এটা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।”
শুধু আর্থিক বা চিকিৎসা সহায়তা নয়, সেনাবাহিনী তরুণদের জীবনে নতুন অনুপ্রেরণাও যোগায়। অনেক আহত শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরেই হতাশায় ভুগছিলেন। সেনাবাহিনীর এই মানবিক উপস্থিতি তাঁদের মনে আশার আলো জ্বেলে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর মনোবিজ্ঞানী দল তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
এই উদ্যোগটি “সোশ্যাল রিহ্যাবিলিটেশন” বা সামাজিক পুনর্বাসনের একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেনাবাহিনী এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুনরায় ফিরে যেতে উৎসাহিত করেছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীতে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ সম্পর্কেও তাদের অবহিত করা হয়।
বগুড়ার স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীর এই মানবিক ভূমিকাকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। সাধারণ মানুষ ও আহত শিক্ষার্থীদের পরিবার এ ঘটনায় দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, সেনাবাহিনী শুধু সীমান্ত পাহারা দেয় না, বরং জাতির ক্রান্তিলগ্নে তারা সবসময় পাশে দাঁড়ায়।
আহত শিক্ষার্থী তানভীর আলমের বাবা বলেন,
“আমার ছেলে রক্ত দিয়েছিল দেশের জন্য। সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ আমাদের বুঝিয়েছে, আমাদের সন্তানদের ত্যাগ বৃথা যায়নি।”
সেনাবাহিনীর এই মানবিক কার্যক্রমের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শুরু হয় প্রশংসার ঝড়। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং বিভিন্ন ব্লগে সেনাবাহিনীর এই কাজকে ‘আদর্শ’ এবং ‘মানবিকতা’র প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন,
“এটাই চেয়েছিলাম আমরা। রাষ্ট্রের যেকোনো শক্তি যদি মানুষের পাশে থাকে, তাহলে আর কোনো ভয় নেই। সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব।”
সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, বরং রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এমন মানবিক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও এধরনের সহায়তা কামনা করেছে।
একজন সংসদ সদস্য বলেন,
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে, তারা কেবল রাষ্ট্রের রক্ষক নয়, মানবিকতারও ধারক।”
এই ঘটনাটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি নতুন রূপকে তুলে ধরেছে। এটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, বরং একটি বৃহত্তর বার্তা বহন করে—মানবিক সহানুভূতি, সামাজিক সংহতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের।
সেনাবাহিনী এই উদ্যোগের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, সহিংসতা নয়, বরং সংলাপ, সহানুভূতি ও মানবিক সহযোগিতা দিয়েই সমস্যা সমাধান সম্ভব।
বগুড়ায় জুলাই আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল মানবিকতার নজির স্থাপন করেনি, বরং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এমন একটি সময় যখন সমাজে হতাশা, বিভেদ ও অবিশ্বাস প্রবল, তখন সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে।
এই প্রতিবেদনের শেষ কথায় শুধু এটুকুই বলা যায় –
“মানুষের পাশে মানুষ থাকলে, দেশ এগিয়ে যায়। আর রাষ্ট্র যদি মানবিক হয়, তাহলে কোনো আন্দোলনের রক্ত বৃথা যায় না।”