জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত
বিশ্ব বাণিজ্যের চিত্র নতুন করে আঁকার পথে হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন আমদানি পণ্যের ওপর নতুন করে যেসব শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, তাতে করে বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্যে বড়সড় ধাক্কার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই শুল্কনীতি এক ধরনের চাপের উৎসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলো এ কারণে প্রবল বৈষম্যের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাড প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষিত নতুন শুল্কনীতি বিশ্ব বাণিজ্যে একটি বৈষম্যপূর্ণ কাঠামো তৈরি করছে, যেখানে দুর্বল ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল “Sparing the Vulnerable: The Cost of New Tariff Burdens”। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির মাত্র ০.৩% অংশের জন্য দায়ী হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তুলনামূলক বেশি শুল্কের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। ফলে মার্কিন বাজারে প্রবেশ আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে পোশাক ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর।
বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এর স্থিতিশীলতা। দীর্ঘ সময় ধরে চালু থাকা ন্যায্যতার ধারণা ও শুল্কহীন বাণিজ্যনীতির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলো মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার পেত। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ঘোষিত শুল্কনীতি সেই ব্যবস্থাকে আঘাত করেছে।
শুল্ক বাস্তবায়নে ৯০ দিনের একটি স্থগিতাদেশ দেওয়া হলেও, অর্থনীতিবিদদের মতে, এই বিরতির প্রভাব খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বরং এই সময়ের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিগুলোকে নিজেদের কৌশল নতুন করে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০% আসে গার্মেন্টস থেকে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হওয়ায়, নতুন শুল্ক আরোপ এই খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
শুল্ক বাড়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বাড়বে, যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় বিকল্প বাজার খোঁজা কিংবা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনাও তেমন বাস্তবসম্মত নয়।
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ফুল, ফল, চা, মসলা ইত্যাদি আমেরিকায় রপ্তানির ক্ষেত্রে ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাড়তি শুল্কের কারণে এই খাতগুলোতেও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এই ধাক্কা সামাল দিতে পারবেন না বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই থেকে দেশভিত্তিক অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের আমদানির ওপর শুল্কহার বেড়ে ৪৪% পর্যন্ত হতে পারে। এটি বাংলাদেশসহ অনেক দেশের জন্য মারাত্মক প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ১০% হারে সর্বজনীন শুল্ক আরোপ করা হলেও, বাংলাদেশের মতো কিছু দেশকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে উচ্চ শুল্ক বসানো হবে, যাকে বাণিজ্য ন্যায্যতা ও আন্তর্জাতিক চুক্তির পরিপন্থী বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে একটি আশাব্যঞ্জক দিকও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, ট্যারিফ রিলিফ বা শুল্ক ছাড়ের নীতিমালা বাস্তবায়ন, এবং সহজ বাজার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।
যদি এমন ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য আরো গভীর হবে, যা বৈশ্বিক উন্নয়নকে দীর্ঘমেয়াদে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
প্রস্তাব করা হয়েছে, আসন্ন বাজেটে ১০০টি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে, যাতে করে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর থেকে উচ্চ শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নরম হয়।
এই প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, দেশটি মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে এবং অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক চায়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ত্রিমুখী কৌশল নিতে হবে:
১. বিকল্প বাজার অনুসন্ধান – ইউরোপ, কানাডা ও চীনসহ অন্যান্য বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করা।
২. রপ্তানি বৈচিত্র্য – শুধুমাত্র পোশাক নির্ভর না থেকে তথ্যপ্রযুক্তি, ঔষধশিল্প, কৃষিপণ্য ইত্যাদি খাতে রপ্তানি সম্ভাবনা খোঁজা।
৩. বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা – যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কৌশলী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে। কেবল আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবাদ জানানো নয়, বরং অভ্যন্তরীণ কাঠামো শক্তিশালী করে এবং নীতিনির্ধারণে গতিশীলতা এনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন কেবল একটি সতর্কবার্তা নয়, বরং এটি একটি আহ্বান—বিশ্ব বাণিজ্যে সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে নীতিনির্ধারকদের একযোগে কাজ করতে হবে।