গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে রাজপথে নতুন প্রজন্মের প্রতিরোধ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের উত্তাল হয়ে উঠেছে শাহবাগ মোড়—দেশের হৃদয়ে অবস্থিত একটি প্রতীকী প্রাঙ্গণ, যা অতীতে বহুবার গণজাগরণের সাক্ষী থেকেছে। সর্বশেষ এক নজিরবিহীন জনসমাবেশে বহু সংখ্যক ছাত্র, তরুণ, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ দাবি জানিয়েছেন: ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত শাহবাগ ছাড়বেন না তারা।’ এই ঘোষণা শুধু রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, এটি একটি আন্দোলনের নতুন ভাষা—যা স্পষ্ট করে দিচ্ছে, জনগণের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ এখন আর নিয়ন্ত্রণে নেই।
গত এক সপ্তাহ ধরে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রথমে কিছুটা ছত্রছায়াভাবে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি একটি সুসংগঠিত প্রতিরোধে রূপ নিয়েছে। আন্দোলনের পেছনে নেতৃত্ব দিচ্ছে কিছু শিক্ষার্থী, নাগরিক সংগঠন এবং তরুণ রাজনৈতিক কর্মী—যারা নিজেদের “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার কমিটি” নামে পরিচয় দিচ্ছেন।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করেছে, মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করেছে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে অবমাননা করেছে। তাদের মতে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা হলে দেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ গণতন্ত্র কখনোই প্রতিষ্ঠা পাবে না।
তাদের বক্তব্য, “একটি রাজনৈতিক দল যদি বারবার সংবিধান লঙ্ঘন করে, মানুষের অধিকার হরণ করে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার করে, তাহলে সে দলকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করাই হবে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা।”
শাহবাগ এখন একটি চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। দিন-রাত ধরে প্ল্যাকার্ড হাতে শত শত মানুষ অবস্থান করছেন। কেউ কবিতা পড়ছেন, কেউ গান গাইছেন, কেউ ব্যানার তৈরি করছেন, আবার কেউবা রাজনৈতিক বক্তৃতা দিচ্ছেন। কেউ কেউ হ্যান্ডমাইক নিয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে বলছেন:
“এই যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এটা কোনো দলীয় আন্দোলন না। এটা জনগণের আন্দোলন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না হলে, আর কোনো নির্বাচন আমরা হতে দেব না।”
এ আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো—এখানে নারী, শিশু ও প্রবীণদের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। কেউ কেউ সঙ্গে করে রান্নার সরঞ্জাম এনে খোলা আকাশের নিচেই খাবার রান্না করছেন। ফলে শাহবাগ এখন যেন একটি ভ্রাম্যমাণ সমাজ, যার কেন্দ্রবিন্দু একটাই: ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করো’।
আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন, যেগুলো তারা বিভিন্ন পোস্টার, মিছিল এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণের সামনে উপস্থাপন করছেন:
- নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংস:
আন্দোলনকারীদের মতে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে বারবার জালিয়াতি, ভুয়া ভোট এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের হুমকি-ধামকি রাজনৈতিক পরিবেশকে পুরোপুরি অস্থির করেছে। - মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ:
অধিকাংশ প্রধান টেলিভিশন চ্যানেল এবং সংবাদপত্র আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মালিকানায় রয়েছে। ফলস্বরূপ, সরকারবিরোধী আন্দোলনগুলোর সংবাদ প্রচারে অবরুদ্ধতা তৈরি হয়েছে। - মানবাধিকার লঙ্ঘন:
গুম, খুন, পুলিশি নির্যাতন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করার অভিযোগ তুলে আন্দোলনকারীরা বলছেন, এই সরকার ‘ফ্যাসিবাদের প্রতীক’ হয়ে উঠেছে। - রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ও দুর্নীতি:
বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি, আত্মীয়করণ, কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। শাহবাগ আন্দোলনের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: “পদ্মা সেতু দুর্নীতির বিচার কবে?”
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে—সংবিধান অনুযায়ী, একটি রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা সম্ভব?
বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সরাসরি বিধান না থাকলেও, গণতন্ত্রবিরোধী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি কোনো দল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, কিংবা সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়, তাহলে আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সম্ভব।
আন্দোলনকারীরা এই আইনি ব্যবস্থার ওপরই জোর দিচ্ছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছে, যা সরাসরি সংবিধানবিরোধী।
এই আন্দোলনের ঢেউ ইতোমধ্যেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর—সবখানেই একই স্লোগান:
“নিষিদ্ধ করো আওয়ামী লীগ, ফিরিয়ে দাও গণতন্ত্র”
বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করলেও দলটির নেতাকর্মীদের একাংশ এই কর্মসূচিকে মৌখিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। তারা বলছেন, “এটি স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান তার পাশে আছে।”
সরকার এই আন্দোলনকে “ষড়যন্ত্রমূলক” আখ্যা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “কিছু উগ্রপন্থী ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া লোক এই ধরনের উসকানিমূলক দাবি তুলে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।”
এই আন্দোলনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। আলজাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স ও নিউ ইয়র্ক টাইমস ইতোমধ্যেই শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, “বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সম্মান করতে হবে।”
বিকেল হতেই শাহবাগ মোড়জুড়ে মানুষের ঢল নামে। কেউ শ্লোগান দেয়, কেউ হ্যান্ডমাইকে গণতন্ত্রের কথা বলে। সন্ধ্যার পরে শাহবাগ পরিণত হয় এক আলোকিত চত্বর হিসেবে। স্ট্রিট থিয়েটার, পথনাটক, প্রতিবাদী গান আর কবিতায় মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। অনেকে ক্যাম্পিংয়ের মতো তাঁবু টাঙিয়ে রাতযাপন করছেন।
আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বলছে, তারা শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা একটি সর্বদলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
“আমরা আর কারো মুখাপেক্ষী নই। রাজপথই আমাদের শক্তি। ইতিহাস যদি রক্ত চায়, আমরা দিতে প্রস্তুত।”
শাহবাগে চলমান এই আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠছে। একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি কতটা কার্যকর হবে বা তা সাংবিধানিকভাবে আদৌ সম্ভব কিনা—তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু স্পষ্ট, জনগণ আর নিঃশব্দে সহ্য করছে না। তারা প্রশ্ন করছে, জবাব চাইছে এবং রাজপথে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছে।
এই আন্দোলন নিছক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়, এটি এক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার সংগঠিত অভ্যুত্থান। যেখানে মূখ্য হয়ে উঠছে একটি নতুন বার্তা: