জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিইও পদে বড় পরিবর্তন
দেশের আলোচিত সংগঠন ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের বোর্ড সভা শেষে এ তথ্য নিশ্চিত করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর ঘোষণার পরই সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা।
বোর্ড সভায় উপস্থিত একাধিক সদস্য জানান, মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ হঠাৎ করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানালে উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হন। যদিও তিনি পদত্যাগের জন্য ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করেছেন, তবে অনেকেই মনে করছেন এর পেছনে রয়েছে গভীর কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপ।
সভায় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “মীর স্নিগ্ধ একটি দুর্দান্ত সময়কাল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পার করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন বিভিন্ন সামাজিক, মানবিক ও গবেষণামূলক কাজে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। আমরা তাঁর অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবো।”
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ নামক একটি আলোচিত ঘটনার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠানটি শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ, গবেষণা, মানবিক সহায়তা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদানসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
২০১৮ সালে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ গতিশীলতা পায়। তাঁর সময়কালে গবেষণা প্রকাশনা, স্মারক অনুষ্ঠান, অনলাইন আর্কাইভ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে তাঁর পদত্যাগে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
যদিও মীর স্নিগ্ধ তাঁর পদত্যাগপত্রে ‘ব্যক্তিগত’ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন, তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এটি নিছক ব্যক্তিগত কোনো ইস্যু নয়। কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদপত্রে ফাউন্ডেশনের আর্থিক লেনদেন এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে গুঞ্জন চলছিল। এমনকি ফাউন্ডেশনের তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়েও গণমাধ্যমে এসেছে একাধিক প্রতিবেদন।
একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত দুই অর্থবছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। যদিও এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে এখনও আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়নি, তবুও বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই ‘চাপের রাজনীতি’ই মীর স্নিগ্ধকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে।
মীর স্নিগ্ধের পর প্রতিষ্ঠানটির পরবর্তী সিইও কে হবেন তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পেতে পারেন ফাউন্ডেশনের বর্তমান পরিচালক (গবেষণা ও নীতি) ড. তানভীর মাহমুদ। তিনি আগে থেকেই ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কৌশলগত নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন।
একই সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে আরেক তরুণ মুখ—জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শাখার সমন্বয়ক ফারজানা তাসনিম, যিনি সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে সাড়া ফেলেছেন।
আজকের বোর্ড সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এটি হবে একটি স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া। সংগঠনের নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা কখনোই আপোষ করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না।”
তিনি আরও জানান, আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে একটি বাছাই কমিটি গঠন করে নতুন সিইও নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে।
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধের পদত্যাগপত্রে উল্লেখ ছিল, “আমি বিগত ৬ বছর ধরে যে দায়িত্ব পালন করেছি, তা ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক ও চ্যালেঞ্জিং। তবে ব্যক্তি জীবনের নানা সীমাবদ্ধতা ও পারিবারিক কারণে এখন অবসর নেওয়াটাই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছি। আমি ভবিষ্যতেও ফাউন্ডেশনের পাশে থাকবো একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে।”
কিন্তু অনেকের মতে, এ বক্তব্য কৌশলগত। ফাউন্ডেশনের অন্তর্জাল পোর্টাল ও অভ্যন্তরীণ তথ্যভাণ্ডার বলছে, গত এক বছরে মীর স্নিগ্ধ একাধিকবার পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়েছেন। বিশেষ করে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা তহবিলের বরাদ্দ নিয়ে প্রতিবেদন গোপন করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতোমধ্যেই মীর স্নিগ্ধকে ঘিরে নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই তাঁর সৃজনশীলতা, নেতৃত্বগুণ ও নিবেদনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন। আবার কেউ কেউ খোলাখুলি সমালোচনাও করছেন তাঁর সময়কালের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে।
ফাউন্ডেশনের এক পুরোনো কর্মী বলেন, “তিনি ছিলেন ভিশনারি, তবে মাঝে কিছু ভুল সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। আমাদের প্রিয় সংগঠনটি যেন আবার সঠিক গন্তব্যে ফিরে যায়, সেটিই এখন কাম্য।”
এই পদত্যাগ নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা কম নয়। বিশেষ করে ফাউন্ডেশনের দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষকতায় যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই এখন মীর স্নিগ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, “একটি সংবেদনশীল স্মৃতি সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকার হতে দেওয়া উচিত হয়নি।”
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেলেও, তাঁর সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে বোর্ডে রাজনৈতিক ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধ শুরু হয়েছিল আগেই। এই অবস্থায় মীর স্নিগ্ধের পদত্যাগ যেন এক রূপক অর্থ বহন করছে—যা বর্তমান নেতৃত্বের জন্য একটি বড় বার্তা।
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধের পদত্যাগ নিঃসন্দেহে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের জন্য একটি বড় ঘটনা। তাঁর সময়কালে প্রতিষ্ঠানটির যেসব অর্জন রয়েছে, তার মূল্যায়ন সময়ই করবে। তবে এও ঠিক যে, নেতৃত্বে রদবদল মানেই একটি নতুন সম্ভাবনার জন্ম। ফাউন্ডেশন তার মূল্যবোধ বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যাবে—এটাই প্রত্যাশা সবার।