পারফিউমে ঢেকে রাখা গন্ধ, নিখোঁজ নাজিম ও স্ত্রীর ভয়ংকর স্বীকারোক্তি—শেষপর্যন্ত নীরবতার দেয়াল ভাঙলো সিআইডি
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার এক শান্ত পাড়ার পুকুরে ২০১৭ সালে ভেসে উঠেছিল একটি মোটা কম্বল। প্রথম দেখায় বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না পেলেও, আশপাশের মানুষ অবাক হয়েছিল—এত ভারী কম্বল কে ফেলে দিলো পুকুরে? সন্দেহের বশে খবর দেওয়া হয় পুলিশকে, ডাকা হয় ডুবুরি। অতঃপর উদ্ধার করা হয় এক অর্ধগলিত অজ্ঞাতনামা মরদেহ। বছর পেরিয়ে যায়, কিন্তু লাশটির পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় কারো নিখোঁজ হবার কোনো খবরও ছিল না। ফলে বিষয়টি একটি ‘কোল্ড কেসে’ রূপ নেয়।
কিন্তু সাত বছর পর সেই রহস্যের জট খুলল। চট্টগ্রামের নারী নাছিমা আক্তার স্বীকার করেছেন—তিনি নিজেই খুন করেছেন তার স্বামী নাজিমকে। আর সেই লাশটিই সাত বছর আগে পুকুরে পাওয়া গিয়েছিল। অবশেষে, সিআইডি এই জটিল হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি টেনেছে।
২০১৭ সালের আগস্টের এক বিকেল। নাছিমা আক্তারের দুই কন্যা ঘরে ঢুকে হঠাৎ টের পায় অস্বাভাবিক এক ঘ্রাণ। বাড়ির ভেতর যেন পারফিউমের অতিরিক্ত গন্ধে ভরে উঠেছে চারদিক। মা’কে বারবার প্রশ্ন করে মেয়েরা—“মা, এই ঘ্রাণ কিসের?”
নাছিমা তখন উত্তর দেননি। কিছুটা উদাস ভঙ্গিতে বলেন, “তোমাদের বাবা হুট করে বিদেশ চলে গেছে।”
কিন্তু এই বিদেশযাত্রার খবর ছিল না কোথাও। কেউ জানতো না, এমনকি নাজিম নিজেই কাউকে কিছু জানাননি।
ঘটনার শুরু আরও কিছুদিন আগে। ২০১৭ সালের জুন মাস। বর্ষাকালে নাছিমা আক্তারের ছেলেটি বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। কোথায় গেল, কী হলো, কেউ জানে না। আশপাশের লোকজনও বিভ্রান্ত, কারণ এমন কোনো মিসিং রিপোর্ট বা হৈচৈ শোনা যায়নি।
স্বামী নাজিম তখন প্রবাসে। স্ত্রীর এই সংকটে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকলেও নাছিমা বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। এমনকি বিদেশ থাকা স্বামীকেও জানাননি ছেলের নিখোঁজ হবার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা খুব দ্রুত বদলে যায়।
নাছিমা’র স্বামী নাজিম হঠাৎ দেশে ফেরেন, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই। উদ্দেশ্য ছিল, স্ত্রী-সন্তানকে সারপ্রাইজ দেওয়া। কিন্তু তার আগমনই যেন স্ত্রীর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাছিমা যেন বিরক্তই হন স্বামীর এই আগমন দেখে।
নাজিমের মন খারাপ হয়। তিনি বুঝতে পারেন কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। বেশিদিন সময় লাগেনি তার বিষয়টা ধরতে—ছেলেটি কোথায়? কেন নিখোঁজ?
নাজিম জানতে পারেন ছেলের নিখোঁজ হওয়ার কথা। স্ত্রীর কাছ থেকেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—এত বড় বিষয় তিনি কেন গোপন রেখেছেন? এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় দাম্পত্য কলহ।
প্রতিদিনই কথা কাটাকাটি বাড়তে থাকে। একদিন রাতে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায়।
২০১৭ সালের ১৮ আগস্ট, ঝগড়ার এক পর্যায়ে নাজিম চড় মারেন নাছিমাকে। তখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নাছিমা ধাক্কা দিয়ে স্বামীকে ফেলে দেন দরজার কানা ঘেঁষে। মাথার হাড় ভেঙে যায় নাজিমের। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে কিছুক্ষণ পর নিথর হয়ে যান তিনি।
একটি জীবন, একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যৎ মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যায়।
নাজিমকে হত্যার পর ঠাণ্ডা মাথায় কার্যক্রম শুরু করেন নাছিমা আক্তার।
প্রথমেই ঘরের ড্রয়ার থেকে স্বামীর পাসপোর্ট বের করে উনুনে পুড়িয়ে ফেলেন—বাংলাদেশে থাকার একমাত্র বৈধ প্রমাণও চিরতরে মুছে দেন। এরপর আলমারির নিচ থেকে মোটা একটি কম্বল বের করে স্বামীর মরদেহ পেচিয়ে রাখেন স্টোররুমে।
এরপর প্রতিদিন স্টোররুমে ঢুকে স্প্রে করতে থাকেন আতর ও পারফিউম। এতটাই পারফিউম ছড়ানো হতো যে, পুরো ঘরেই যেন মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াত। দুই কন্যা অবাক হয়ে মাকে প্রশ্ন করে, কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি।
মরদেহ সাত দিন ছিল স্টোররুমে। তারপর এক গভীর রাতে নাছিমা কম্বলে মোড়ানো লাশ বাড়ির পেছনের পুকুরে ফেলে দেন। এত নিখুঁতভাবে কাজ করেন তিনি যে, সাত বছরেও কেউ কিছু বুঝতে পারেনি।
কিছুদিন পর পুকুরে ভেসে ওঠে সেই কম্বল। আশপাশের মানুষের সন্দেহ বাড়ে। খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। ডুবুরি দিয়ে তল্লাশি করে এক অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল—এই লাশ কার? কেউ তো নিখোঁজ না।
পুলিশ প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান চালালেও কোনো সুরাহা হয় না। ফলে দুই বছরের মাথায় মামলাটি হস্তান্তর করা হয় সিআইডির কাছে।
সিআইডি মামলার জট খোলার জন্য অনুসন্ধান শুরু করে। প্রথমেই নজরে আসে—নাছিমা আক্তারের স্বামী সাত বছরেও কেন দেশে ফেরেননি?
আরব আমিরাতে অনেকেই রাজনৈতিক কারণে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সবাই পরে মুক্তি পেয়েছিলেন। নাজিমের ক্ষেত্রে তা হয়নি কেন?
এই প্রশ্ন থেকেই সন্দেহ গাঢ় হয়। সিআইডি নজরদারি শুরু করে নাছিমা আক্তার ও তার পরিবারের উপর। অবশেষে নাছিমা ও তার দেবরকে আটক করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে নাছিমা ভেঙে পড়েন। তিনি স্বীকার করেন—স্বামী নাজিমকে তিনিই হত্যা করেছেন এবং লাশ পুকুরে ফেলে দিয়েছেন।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, সাত বছর আগে চট্টগ্রামের রাউজানের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত মরদেহের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আনা হয় নাছিমা আক্তারকে। গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী দেবরকেও।
ঘটনার পর প্রতিবেশীরা হতবাক। তারা বলছেন—“এমন ভদ্র, নিরীহ পরিবারে এমন ঘটনা ঘটবে, কেউ ভাবেনি।”
নাছিমার দুই কন্যা বর্তমানে আত্মীয়দের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সামাজিক ও মানসিকভাবে তারা এক গভীর সংকটে।
সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, “এটি অত্যন্ত দুরূহ এবং জটিল একটি মামলা ছিল। আমরা কোনো সূত্র পাচ্ছিলাম না। শুধুমাত্র ধৈর্য, গোয়েন্দাগিরি আর বিশ্লেষণ দিয়েই সাত বছর আগের সত্যকে তুলে আনা সম্ভব হয়েছে।”
নাছিমা আক্তার ও তার দেবরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন নাছিমা।
এখন দেখা যাক, বিচারিক প্রক্রিয়ায় কী রায় আসে।