ইশরাক হোসেনের নামে গেজেট প্রকাশ: আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত ছাড়াই কমিশনের সিদ্ধান্ত
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের নাম গেজেটে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার আগেই। ফলে এ নিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
২০২০ সালের ডিএসসিসি নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম। এই রায় আসে গত ২৭ মার্চ। আদালতের এই নির্দেশনাকে বাস্তবায়ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল নির্বাচন কমিশনের।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, “আমাদের ১০ দিনের মধ্যে আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে হতো। সেই সময়সীমার মধ্যেই গেজেট প্রকাশ করেছি। আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ায় কমিশন স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেয়।”
ইসি সূত্রে জানা যায়, আদালতের রায়ের পর গত ২২ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। ২৫ এপ্রিল ছিল সেই ১০ দিনের সীমা। তবে এরপর দুদিন সরকারি ছুটি ছিল। ইসি রবিবার (২৭ এপ্রিল) পর্যন্ত অপেক্ষা করে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোনো মতামত না পাওয়ায় গেজেট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
কমিশনার সানাউল্লাহ জানান, “আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের ওপর নির্ভর করতে চাইনি, কারণ আদালতের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা এবং তা কার্যকর করাই ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব।”
আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, “নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তারা চাইলে গেজেট প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু তারা যখন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে, তখন সেই মতামতের আগেই গেজেট প্রকাশ করাটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই মামলায় প্লেইন্ট (আরজি) পরিবর্তনের মতো কিছু জটিলতা ছিল, যা সাধারণত নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে অনভিপ্রেত। এটি কমিশনের মধ্যে দ্বিধা তৈরি করেছিল, এবং তারা আপিল নিয়ে চিন্তা করছিল।”
২০২০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন ফলাফলের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল তার অভিযোগ আমলে নিয়ে রায় দেয়, যাতে তাপসের জয় বাতিল এবং ইশরাককে বৈধ মেয়র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
রায়ে বলা হয়, ভোটের সময় কিছু কেন্দ্রের ফলাফল বাতিলযোগ্য এবং নির্বাচন পরিচালনায় পক্ষপাতিত্ব হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এই যুক্তিতে রায় দেয় যে, প্রকৃত ভোটারের রায়ের প্রতি সম্মান জানাতে হবে।
বিএনপি নেতারা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। দলটির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, “এটি আইনের বিজয়। আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।”
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, তারা আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি মোকাবিলা করবেন। তাপসের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপিল করার চিন্তা চলছে বলেও জানা গেছে।
নতুন মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেন দায়িত্ব নেবেন কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, তাপস এখনো মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। গেজেট প্রকাশের পরপরই নতুন মেয়রের শপথ গ্রহণ এবং দায়িত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আপিল হলে তা বিলম্বিত হতে পারে।
কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, “গেজেট প্রকাশের পর স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এখন শপথ ও দাফতরিক হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।”
এই ঘটনা নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যক্ষমতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও সংবিধান অনুযায়ী ইসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তবে প্রায়ই রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক চাপের কারণে তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়ার অভিযোগ রয়েছে। এই গেজেট প্রকাশ অনেকের চোখে ইসির স্বতন্ত্র অবস্থান প্রদর্শনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের অনুপস্থিতিতে গেজেট প্রকাশ একটি সাহসী পদক্ষেপ হলেও, এর ভবিষ্যৎ আইনগত চ্যালেঞ্জ থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে যদি মামলার আরজি বা প্রক্রিয়াগত ত্রুটি প্রমাণিত হয়।
ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঘটনা। নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে একটি নজির হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, এই সিদ্ধান্ত কতটা টিকে থাকে এবং উচ্চ আদালতের রায় কীভাবে এর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।