চীনের সীমান্ত প্রস্তুতি বাড়াচ্ছে উদ্বেগ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের পেহেলগামে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন নিরীহ পর্যটক। এই রক্তক্ষয়ী হামলার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভারত। দেশব্যাপী নেমে এসেছে শোকের ছায়া, আর আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এই হামলার পেছনে সরাসরি পাকিস্তানের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত রয়েছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও সামরিক উত্তেজনা চরমে উঠেছে। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের ২৬ বছর পর নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তবে এবার সংঘর্ষের মাত্রা আরও ব্যাপক হতে পারে, কারণ এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে চীনও সক্রিয়ভাবে নিজেদের সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করছে।
ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) গত ২০২৪ সাল থেকেই পাঁচটি কৌশলগত বিমানঘাঁটি আধুনিকীকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই বিমানঘাঁটিগুলো হচ্ছে: টিংরি, লুহুজি, বুরাং, ইউটিয়ান ও ইয়ারকান্ড। এগুলোর প্রতিটিতেই যুক্ত করা হয়েছে অত্যাধুনিক স্পেস ইঞ্জিন টেস্ট প্যাড, সাপোর্ট স্ট্রাকচার ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার সিস্টেম।
ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে যে এই উন্নয়নমূলক কাজগুলো কেবল প্রতিরক্ষার জন্য নয়, বরং আক্রমণাত্মক প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলে অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা।
বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা বিশ্লেষক ড্যামিয়েন সাইমন বলেন, “চীন ও পাকিস্তান এক যৌথ কৌশলগত কনফিগারেশনে কাজ করছে। পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা ঘটালে চীন সীমান্তে চাপ সৃষ্টি করে ভারতীয় বাহিনীকে বিভ্রান্ত করছে।” তিনি আরও জানান, এটি প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার একটি অংশ, যার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য বিস্তার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
Defence Times-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ইতোমধ্যেই ভারতের সীমান্তবর্তী আকাশসীমায় হাই অল্টিটিউড লং ইন্ডিউরেন্স (HALE) ড্রোন ও গোয়েন্দা এয়ারক্রাফট মোতায়েন করেছে। এই ড্রোনগুলো ৫০০ ফুট উচ্চতায় দীর্ঘ সময় ধরে উড়ে থেকে তথ্য সংগ্রহে সক্ষম। এই কার্যক্রম ভারতীয় নিরাপত্তা কাঠামোতে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে।
২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এক বক্তব্যে বলেন, “কাশ্মীর নিয়ে আমরা তিনটি যুদ্ধ করেছি, প্রয়োজনে আরও ১০টি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।” এই বক্তব্যের ঠিক দুই মাসের মধ্যেই এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করে লাইন অফ কন্ট্রোল অতিক্রম করে অতর্কিত গুলিবর্ষণ চালায়। ঘটনাটি ঘটে কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশ রুখে দেওয়া হয়েছে এবং তাদেরকে সীমান্তে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষজনের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পেহেলগামের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন একযোগে নিন্দা জানালেও, ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন চীনের প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক হলেও সামরিক কার্যক্রম পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই হামলার নেপথ্যে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ উপস্থাপন করতে শুরু করেছে।
বিশ্লেষক জন বেগ বলেন, “চীনের এই পদক্ষেপ ভারতকে চাপের মধ্যে ফেলতে পারে। বিশেষ করে যখন ভারত একযোগে দুই ফ্রন্টে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হচ্ছে।”
এই মর্মান্তিক হামলা সংঘটিত হয় ২০২৫ সালের ১৫ এপ্রিল পেহেলগামের পর্যটন এলাকায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, হঠাৎ করেই একদল সশস্ত্র হামলাকারী পর্যটকদের বহনকারী বাসে গুলি চালায় ও গাড়ির নিচে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ঘটনাস্থলেই ১৮ জন নিহত হন, পরে হাসপাতালে নেয়ার পর আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন কমপক্ষে ৩০ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ভারতীয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী হামলার পরপরই এলাকা ঘিরে ফেলে অভিযান চালায়। তবে এখনো পর্যন্ত কোনও জঙ্গি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, পাকিস্তানের মদদপুষ্ট লস্কর-ই-তইয়েবা বা জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো সংগঠন এই হামলার পেছনে থাকতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী লাইন অফ কন্ট্রোলসহ আন্তর্জাতিক সীমান্তে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর গ্রামগুলো খালি করে বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিমানবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে সম্ভাব্য আকাশপথে হস্তক্ষেপ মোকাবিলায়।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সীমান্তে নজরদারির জন্য ইসরায়েলি ড্রোন, রাডার প্রযুক্তি ও হেলিকপ্টার টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে ভারত যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপে যায়, তাহলে চীনের সক্রিয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ত্রিমুখী সংঘাতের আশঙ্কা যেমন বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মিত্রতা ও বিরোধিতার মানচিত্রও পাল্টে যেতে পারে।
পেহেলগামের হামলার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নতুন মোড় নিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক চিরকালই উত্তপ্ত থাকলেও, এবার চীনের সক্রিয়তা এই উত্তেজনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। ভারত এই মুহূর্তে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে দ্বিমুখী চাপের মধ্যে পড়েছে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা নির্ভর করছে আগামী কয়েক সপ্তাহের কূটনৈতিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর। তবে স্পষ্টতই বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে এশিয়ার দুই পরাশক্তির মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।