প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ডে মামলা: অভিযুক্ত ৮ শিক্ষার্থী
রাজধানীর বনানীতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ডে বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীসহ মোট আটজনকে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে পাঁচজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত। রোববার বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল সারোয়ার গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, নিহত জাহিদুলের ভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। মামলায় নাম উল্লেখ করা শিক্ষার্থীরা হলেন মাহাথি, মেহেরাব, আবুজর গিফারি, শোভহান নিয়াজ (তুষার), হৃদয় মিয়াজী, মাহাদী হাসানসহ আরও দুই শিক্ষার্থী। তাঁরা সকলেই প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের দুই ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগকে কেন্দ্র করে জাহিদুলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাকবিতণ্ডা হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষকে ডেকে মীমাংসার চেষ্টা করে। তবে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পরপরই জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে একদল যুবক ছুরিকাঘাত করে।
গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত জাহিদুল ছিলেন প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রোববার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। তিনি বলেন, “তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হামলার নেতৃত্ব দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।”
ছাত্রদল সভাপতি আরও দাবি করেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বনানী থানা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শোভহান নিয়াজ (তুষার), যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজী এবং প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্রনেতা আবু জর গিফারি ও মাহাদী হাসান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
তিনি বলেন, “প্রক্টরের উপস্থিতিতে মীমাংসার পরও হামলা প্রমাণ করে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, “মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে এবং আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।” তিনি আরও জানান, সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য তদন্তে সহায়ক হবে।
ঘটনার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া একটি পোস্টে নিহত জাহিদুলকে ঘিরে দেওয়া কিছু মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রদল নেতারা।
ছাত্রদল সভাপতি বলেন, “তদন্তের আগেই অভিযুক্তদের পক্ষ নেওয়া হয়েছে। এটা সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি অসম্মান। অভিযুক্তদের বাঁচাতে একটি পক্ষ সংগঠনের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে।”
তাঁর অভিযোগ, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতেই কিছু সংগঠন মব স্টাইলে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এটা নতুন নামে পুরাতন ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ।”
পরিবারের আহাজারি ও বিচার দাবি
জাহিদুলের পরিবার ঘটনার পর থেকে শোকে মুহ্যমান। তাঁর ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, “আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে শুধু তার সহপাঠীদের সম্মান রক্ষায় কথা বলেছিল। অথচ তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হলো। আমরা চাই, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।”
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক ও সহনশীল হয়, ততক্ষণ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে। নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পাসে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন।
ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক সমাজ জাহিদুল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
তারা বলছে, “এ ধরনের সহিংসতা শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে কলুষিত করে। রাষ্ট্রের উচিত দোষীদের রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে আইনের আওতায় আনা।”
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি দেশের শিক্ষাঙ্গনে ক্রমবর্ধমান সহিংস ছাত্ররাজনীতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ঘটনায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও অনেক জাহিদুলকে হারাতে হতে পারে। তদন্ত যেন নিরপেক্ষ হয় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়—এটাই এখন সর্বস্তরের মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা।