যশোরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে পুলিশের অভিযান
গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই আত্মগোপনে থাকা যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। আজ রোববার (তারিখ) দুপুরে সাতটি গাড়ির একটি বড় বহর নিয়ে পুলিশ জেলার শহরের বিভিন্ন এলাকায় এই অভিযান পরিচালনা করে। যদিও অভিযানে কাউকে আটক কিংবা কোনো কিছু উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তবে স্থানীয় জনমনে তীব্র উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
দুপুরে প্রথমে পুলিশের বহর গিয়ে উপস্থিত হয় শহরের কাঁঠালতলায় অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের বাড়িতে। জানা যায়, সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়িটি আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর থেকে শাহীন চাকলাদার ও তার পরিবার ওই বাসায় অবস্থান করছেন না। বর্তমানে সেখানে সংস্কার কাজ চলছে এবং বাসাটি খালি রয়েছে।
স্থানীয় শ্রমিকরা জানান, পুলিশ সদস্যরা এসে তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং জিজ্ঞেস করেন শাহীন চাকলাদার বাড়িতে আছেন কি না। এরপর কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটিয়ে পুলিশ চলে যায়।
এরপর পুলিশ যাত্রা করে পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও যুবলীগের প্রচার সম্পাদক জাহিদ হোসেন ওরফে টাক মিলনের বাড়ির দিকে। সেখান থেকে পরপর অভিযান চালানো হয় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জুয়েল, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল এবং সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুলের বাড়িতে। প্রতিটি বাড়িতেই পুলিশ উপস্থিত হয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এবং তদন্ত শেষে ফিরে আসে।
যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসনাত সাংবাদিকদের জানান, “আমাদের অভিযান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং মামলার আসামিদের ধরার জন্য নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়নি।”
একই সঙ্গে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িগুলোতে বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামিরা লুকিয়ে থাকতে পারে। যদিও এ অভিযানে কাউকে আটক করা যায়নি, তবে তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।”
আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলামের ভাবি জ্যোৎস্না বেগম বলেন, “আমাদের বাসায় পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করেছিল জুয়েল বাসায় আছে কি না। আমরা জানিয়েছি, সে অনেক দিন ধরেই বাড়িতে নেই। পুলিশ বিনা ঝামেলায় চলে গেছে।”
অন্যদিকে অভিযানের সময় স্থানীয় জনতার মধ্যে দেখা দেয় উৎকণ্ঠা। কেউ কেউ বাসার সামনে ভিড় করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। অনেকেই বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে নয়, যদি প্রকৃত অপরাধীদের খোঁজেই অভিযান হয়, তাহলে তাতে আপত্তি নেই। তবে শুধুমাত্র দলের নাম জড়িয়েই যদি অভিযানে নামা হয়, তাহলে সেটা উদ্বেগজনক।”
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সারা দেশে এখন আমাদের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। এগুলো বন্ধ করতে না পারলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফলে একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে এমন অভিযান চালানো হচ্ছে।”
তাদের মতে, “পুলিশ যদি প্রকৃত আসামিদের খোঁজে অভিযান চালায়, সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে শুধুমাত্র দাপট দেখাতে অভিযান চালালে সেটি গণতন্ত্রের পরিপন্থী।”
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ের গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে চাপে রয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় নেতা-কর্মীদের বাসভবনে হামলা, অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পর বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপকেই এখন সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের অভিযান রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। যদি এটি শুধুমাত্র মামলার আসামিদের ধরার উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তা আইনগত দিক থেকে যৌক্তিক। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার চেষ্টা হিসেবে চালানো হলে তা দীর্ঘমেয়াদে আরও সংকট সৃষ্টি করবে।
পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ ধরনের অভিযান চলমান থাকবে। প্রতিটি এলাকায় নিয়মিত তল্লাশি এবং সন্দেহভাজনদের ধরার কাজ অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশি তৎপরতার বিষয়ে নজরদারি রাখা হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজকের অভিযানে যশোর শহরের অন্তত ছয়টি বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে কোথাও কোনো সংঘর্ষ বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। স্থানীয়দের আশা, পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে এবং সাধারণ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা হবে।