সৌদি আরবে হজে নতুন কড়া নিয়ম: অনুমতি ছাড়া মক্কায় প্রবেশ নিষিদ্ধ
সৌদি আরবে আসন্ন হজ মৌসুমকে ঘিরে নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছে দেশটির সরকার। এই লক্ষ্যে ২০২৫ সালের হজ মৌসুমের জন্য নতুন হজবিষয়ক নির্দেশনা ও কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। ২৩ এপ্রিল (২০২৫) থেকে এই বিধিনিষেধ কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। হজ মৌসুমে বিশাল সংখ্যক হজযাত্রী মক্কা শহরে সমবেত হন, ফলে বিশৃঙ্খলা এড়াতে এবার পুরো ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিনির্ভরতা ও নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়েছে।
সৌদি আরবের পাবলিক সিকিউরিটি ডিরেক্টরেটের প্রকাশিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, হজ মৌসুমে মক্কা শহরে প্রবেশ করতে চাইলে অবশ্যই অনুমোদিত কাগজপত্র থাকতে হবে। এই নিয়ম শুধু বিদেশি হজযাত্রীদের জন্য নয়; বরং সৌদি নাগরিক ও প্রবাসী বাসিন্দাদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। যাদের কাছে বৈধ অনুমতিপত্র থাকবে না, তাদের মক্কার চারপাশে স্থাপিত নিরাপত্তা চৌকিতে থামিয়ে ফেরত পাঠানো হবে।
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, নিম্নলিখিত যে কোনো একটি বৈধ নথি থাকতে হবে মক্কায় প্রবেশের জন্য:
১. পবিত্র স্থানগুলোতে কাজ করার জন্য নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত অনুমতিপত্র। ২. মক্কায় নিবন্ধিত বসবাসের প্রমাণ (ইকামা)। ৩. সরকারিভাবে ইস্যুকৃত হজ পারমিট।
নতুন এই বিধিনিষেধের মূল উদ্দেশ্য হলো, পবিত্র শহর মক্কায় হজ মৌসুমে অতিরিক্ত ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে আগমন করেন, ফলে শৃঙ্খলার সঙ্গে হজ ব্যবস্থাপনা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এবার ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সেই ব্যবস্থাপনা সহজতর করতে চায় সৌদি প্রশাসন।
হজ মৌসুমে যারা মক্কা শহরে প্রবেশ করতে চান, তাদের জন্য অনলাইনে অনুমতিপত্র সংগ্রহের সুযোগ রাখা হয়েছে। সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘আবশের ইনডিভিজুয়্যালস’ (Absher Individuals) এবং ‘মুকিম’ (Muqeem)–এর মাধ্যমে এই আবেদন করা যাচ্ছে।
এই সিস্টেম ‘তাসরিহ’ (Tasreeh) নামক ইউনিফায়েড পারমিট সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রবাসী কর্মীরাও এই সিস্টেমের মাধ্যমে ডিজিটালভাবে পারমিট সংগ্রহ করতে পারছেন। এতে সময় ও হয়রানি কমবে বলে মনে করছেন হজ কর্তৃপক্ষ।
সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলেছে, হজ পালনের জন্য প্রত্যেক হজযাত্রীকে অবশ্যই ‘নুসুক’ (Nusuk) নামক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে হজ পারমিট সংগ্রহ করতে হবে। এটি ‘তাসরিহ’ ইউনিফায়েড সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত এবং সৌদি সরকারের অফিসিয়াল হজ ব্যবস্থাপনার অন্তর্গত।
সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় আরও সতর্ক করে বলেছে, ওমরাহ, ভিজিট বা টুরিস্ট ভিসায় হজ পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র অনুমোদিত হজ পারমিটধারী ব্যক্তিরাই হজ পালন করতে পারবেন। ভিসা আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া হজ ক্যাম্পেইনের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে। এসব ক্যাম্পেইনে লাইসেন্সবিহীন আবাসন, পরিবহন বা অবৈধভাবে হজ সম্পন্ন করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
জনসাধারণকে এই ধরনের প্রতারণার ফাঁদে না পড়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এ ধরনের কোনো প্রচারণা চোখে পড়লে তা দ্রুত কর্তৃপক্ষকে জানাতে। জরুরি হটলাইন কিংবা স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় রিপোর্ট করা যেতে পারে।
সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এসডিএআইএ (Saudi Data and Artificial Intelligence Authority) যৌথভাবে ‘তাসরিহ’ নামক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। এই সেন্ট্রালাইজড পারমিট ব্যবস্থার মাধ্যমে মক্কায় প্রবেশকারী হজযাত্রী, স্বেচ্ছাসেবক, কাজরত কর্মী এবং অনুমোদিত যানবাহনের জন্য পারমিট ইস্যু করা হচ্ছে।
পারমিটধারীরা ‘তাওয়াক্কালনা’ (Tawakkalna) অ্যাপে লগইন করে তাদের অনুমতির বর্তমান অবস্থা বা স্ট্যাটাস দেখে নিতে পারেন। এতে হজ ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা আরও বৃদ্ধি পাবে।
সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হজ মৌসুম শুরুর আগে ওমরাহ ভিসাধারীদের সৌদি আরব ত্যাগের সর্বশেষ সময়সীমা ২৯ এপ্রিল (১ জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি)। এই তারিখের পরে ওমরাহ ভিসাধারীদের সৌদি আরবে অবস্থান অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে।
যারা এই সময়সীমার পরে সৌদি আরবে অবস্থান করবেন, তাদের বিরুদ্ধে কারাদণ্ড, জরিমানা এবং ফেরত পাঠানোসহ আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
সৌদি সরকার এর আগেও বহুবার ভিসার শর্ত লঙ্ঘনকারী ও অবৈধ হজযাত্রীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। যারা বৈধ পারমিট ছাড়া হজ পালনের চেষ্টা করবেন কিংবা মক্কা শহরে প্রবেশ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের জরিমানা, জেল এবং ডিপোর্টেশনের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি, এই নতুন নির্দেশনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার মাধ্যমে হজ ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। লক্ষ্য হচ্ছে, বিশাল সংখ্যক মানুষের চলাচল ও অবস্থানকে সুসংগঠিত রাখা এবং ধর্মীয় আচার পালনে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
এই কঠোর বিধিনিষেধ ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনার ফলে হজযাত্রীদের নিরাপত্তা, সেবা ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হবে আরও সুচারু এবং আত্মিক।
সৌদি আরব সরকারের নতুন হজবিষয়ক নিয়ম ও নির্দেশনা বিশ্বব্যাপী হজযাত্রীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই পবিত্র দায়িত্ব পালনের সময় যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে, সেজন্য কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যারা হজে যেতে ইচ্ছুক, তাদের উচিত এই বিধিনিষেধ যথাযথভাবে অনুসরণ করে পারমিট সংগ্রহ করা এবং কোনো প্রকার ভুয়া বিজ্ঞাপন বা ক্যাম্পেইনের ফাঁদে না পড়া।