জিয়া মঞ্চে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার উত্থান: হাতিয়ায় নতুন বিতর্কের ঝড়
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক নেতা জামসেদুল ইসলাম টুটুলকে জিয়া মঞ্চের সভাপতি হিসেবে ঘোষণার পর সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি ঘিরে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী, জিয়া মঞ্চের সদস্য এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ ও বিভ্রান্তি।
জানা গেছে, জামসেদুল ইসলাম টুটুল পূর্বে হরণী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় একধরনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। অসহায় সাধারণ মানুষ, এমনকি বিরোধী দলের কর্মীদের ওপরও তিনি দমন-পীড়ন চালিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, টুটুল ছিল তৎকালীন এমপি মোহাম্মদ আলীর ঘনিষ্ঠজন এবং তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। সেই সময় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলার নেপথ্যে তার ভূমিকা ছিল বলে তারা দাবি করেন।
সম্প্রতি জিয়া মঞ্চের হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়ন শাখার ২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়েছে, যেখানে জামসেদুল ইসলাম টুটুলকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই ঘোষণার পরপরই স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
হরণী ইউনিয়নের একজন সাবেক ছাত্রদল নেতা বলেন, “টুটুল যে আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে, সেটা সবাই জানে। এখন সে কিভাবে জিয়া মঞ্চের সভাপতি হয়, সেটা আমাদের মাথায় আসে না।”
এই প্রসঙ্গে জামসেদুল ইসলাম টুটুল বলেন, “আমাকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল আমার অজান্তে এবং অসম্মতিতে। পরে আমি লিখিতভাবে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন ইউনিয়ন সভাপতি ছিলাম এবং তখন আমাকে প্রচুর নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল নৌকার পক্ষে ভোট দিতে এবং মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যেতে। আমি কখনো মন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করিনি।”
জিয়া মঞ্চের হাতিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রিপন চন্দ্র দাস স্বীকার করেছেন যে, টুটুল আগে থেকেই জিয়া মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা জানতাম না যে তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে নাম লিখিয়েছেন। বিষয়টি সামনে আসার পর আমরা সেই কমিটি আপাতত স্থগিত রেখেছি। তদন্ত করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল উদ্দিন রাশেদ বলেন, “যারা ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছে, তারা বিএনপির ছায়াতলে থাকতে পারবে না। টুটুল যদি সত্যিই স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে ছিল, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই সঙ্গে যারা তাকে জিয়া মঞ্চের পদে নিয়ে এসেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা জিয়া মঞ্চের আহ্বায়ক মো. মনির হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে পরে কথা বলব।”
হরণী ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা ও ভোটার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “রাজনীতিতে এখন আর আদর্শ নাই, সবাই ক্ষমতার স্বাদ নিতে চায়। আগে একজন আওয়ামী লীগের হয়ে দাপট দেখালো, এখন বিএনপির নাম ভাঙিয়ে আবার সুবিধা নিতে চায়। এমন লোক দিয়ে জিয়া মঞ্চ চলতে পারে না।”
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রহিমা আক্তার বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম ত্যাগী ও আদর্শবান নেতারা আসবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যেই লাউ সেই কদু। জনগণ আবারও বিভ্রান্ত হচ্ছে।”
ঘটনার পর থেকেই ফেসবুক ও টুইটারে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই টুটুলের পুরনো কর্মকাণ্ডের তথ্য, ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে জিয়া মঞ্চের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত দলীয় আদর্শ ও সংগঠনের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে না কি?
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবদুল করিম বলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোতে আদর্শের চেয়ে সুবিধাভোগীদের আধিক্যই বেশি দেখা যায়। এ কারণে একজন ব্যক্তি এক সময়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবার পরবর্তী সময়ে বিএনপির পদপ্রাপ্ত নেতা হয়ে যেতে পারেন। এটা রাজনৈতিক মূল্যবোধের সংকট।”
তিনি আরও বলেন, “বিরোধী দলগুলোর উচিত হবে ত্যাগী, নির্যাতিত ও আদর্শবান কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়া। না হলে জনগণ তাদের ওপর আস্থা হারাবে।”
জামসেদুল ইসলাম টুটুলের জিয়া মঞ্চে পদপ্রাপ্তির ঘটনাটি শুধু একটি ব্যক্তি বা ইউনিয়নের বিষয় নয়। এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে আদর্শ নয়, বরং ক্ষমতা ও সুবিধা প্রাধান্য পায়।
এই ঘটনার মাধ্যমে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে—তারা কী আদর্শিক নেতৃত্বে বিশ্বাসী, নাকি রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে? ভবিষ্যৎ রাজনীতি কীভাবে এগোবে, তা নির্ভর করবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও প্রয়োগিক বাস্তবায়নের ওপর।