নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন: সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানালো এনসিপি
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেনি। অথচ ইসির জারি করা গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, আগামী রবিবার (২০ এপ্রিল) শেষ হচ্ছে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা। এই সময়সীমা আরও ৯০ দিন বাড়ানোর জন্য বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) নির্বাচন কমিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠি জমা দিয়েছে এনসিপি। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রবিবার দুপুর ১২টায় তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং নিবন্ধন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।
এনসিপির যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিবন্ধনের ব্যাপারে অগ্রসর হতে চাই। তবে বর্তমান প্রক্রিয়া এবং শর্তাবলি অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক। সেগুলোর সংস্কার ছাড়া একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে সামনে এগোনো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।”
ইসির ঘোষণা অনুযায়ী, ১০ মার্চ থেকে নতুন দলগুলোর নিবন্ধনের আবেদন গ্রহণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৩৮ দিন পার হয়ে গেলেও মাত্র ১১টি দল আবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে ১০টি দলই মূলত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। অর্থাৎ মূল আবেদন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পূরণ করতে পারেনি অধিকাংশ দলই।
‘আওয়ামী লিগ’ নামে একটি নতুন দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও, তা যথাযথ নথিপত্র না থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করেনি।
আইন অনুযায়ী, নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক নিয়ে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদনপ্রাপ্ত নিবন্ধনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দল হওয়া বাধ্যতামূলক। এ অবস্থায় সময়সীমা না বাড়ালে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ভোটে অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়বে।
এনসিপি মনে করছে, নিবন্ধনের বর্তমান শর্তগুলো অপ্রাসঙ্গিক ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদবিরোধী। তারা বলছে, ২০০৮ সালে তৈরি হওয়া নিবন্ধন বিধিমালাগুলো ছিল তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসনের ফসল, যেগুলোর লক্ষ্য ছিল বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ করা এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সংকুচিত করা।
নিবন্ধনের সময়সীমা বাড়ানো হবে কি না—এই প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানান, “এখনো পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে জমা পড়া অধিকাংশ আবেদনে অতিরিক্ত সময় চাওয়া হয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে রোববার কমিশনের বৈঠকে আলোচনা করব।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করতে চাই। সেজন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া তিন মাসের মধ্যেই শেষ করতে চাই। ফলে হাতে সময় খুব সীমিত।”
বর্তমানে কার্যরত রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালার আওতায় যে শর্তগুলো রয়েছে, তা নতুন দলের জন্য বিশেষ করে গ্রামীণ ও তুলনামূলক ছোট সংগঠনগুলোর জন্য অনেক কঠিন। শর্তগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মহানগরে সংগঠন থাকতে হবে;
- অন্তত ২০টি জেলায় কার্যক্রম থাকতে হবে;
- সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে কমপক্ষে একটি আসনে বিজয়ী হতে হবে অথবা ৫ শতাংশ ভোট পেতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এই বিধিমালায় শর্ত সহজ করার সুপারিশ করেছে। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে সংগঠন গঠনের শর্ত ১০ শতাংশে এবং উপজেলা পর্যায়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। পাশাপাশি প্রতি পাঁচ বছরে নিবন্ধিত দলগুলোর জন্য নিবন্ধন নবায়ন বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হয়েছে।
এনসিপিও এই সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর বিকাশে এসব শর্ত শিথিল করা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য থাকা আবশ্যক। বর্তমান শর্তাবলি রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে এবং নতুন শক্তিগুলোর জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে ওঠে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, “নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে বাধা দিলে দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থবির করে ফেলবে। বরং আরও উদারনীতি অনুসরণ করা উচিত যাতে রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে।”
বৃহস্পতিবার জমা দেওয়া চিঠিতে এনসিপি যে কয়টি বিষয় তুলে ধরেছে, তা হলো:
- বর্তমান নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্থগিত করে সময়সীমা অন্তত ৯০ দিন বাড়ানো;
- নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে পরিচালনা;
- বর্তমান নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন না করা পর্যন্ত নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা;
- নিবন্ধিত দলের নিবন্ধন নবায়নের বাধ্যবাধকতা চালু করা;
- প্রতিটি দলের জন্য কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরি করা।
বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৪টি। তবে বিভিন্ন সময়ে শর্ত পূরণ না করায় এবং আদালতের আদেশে ৫টি দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়া দলগুলোর মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি এবং জাগপা।
২০১৮ সালে ৭৬টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও কোনো দলই শর্ত পূরণ করতে না পারায় নির্বাচন কমিশন তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পরে ২০১৯ সালে আদালতের নির্দেশে ববি হাজ্জাজের দল ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)’ নিবন্ধন লাভ করে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর মতে, ইসি যদি সময়সীমা না বাড়ায় তবে নতুন দলগুলো নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে একরকম ছিটকে পড়বে। এর ফলে নির্বাচনী বৈচিত্র্য ও অংশগ্রহণ কমে যাবে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হতে পারে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সবার জন্য নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। ইসি যদি সময় না বাড়ায়, তাহলে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ অনেক নতুন রাজনৈতিক দলই মনে করে, বর্তমান নিবন্ধন ব্যবস্থা সংস্কার ছাড়া এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
রবিবার (২০ এপ্রিল) নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের দিকেই এখন তাকিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলগুলো। তারা আশাবাদী, ইসি এই বিষয়ে গণতন্ত্রের স্বার্থে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেবে।