সংবিধান সংশোধনে গণভোট নিয়ে দ্বিমত বিএনপির
সাংবিধানিক সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্বিন্যাস নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ১৭ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদের এলডি হলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদসহ চার সদস্যের প্রতিনিধি দল।
সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, সংবিধানের সব ধরনের সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট বাধ্যতামূলক করা যাবে না। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ ও মূলনীতির ক্ষেত্রে গণভোট জরুরি বলে মত দিয়েছে দলটি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিটি সংশোধনী রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আগে গণভোটে তোলার প্রস্তাবে আমরা দ্বিমত জানিয়েছি। আমরা মনে করি, সংবিধানের ৪৮, ৫৬, ১৪২ অনুচ্ছেদ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু সব ধরনের সংশোধনীতে গণভোট বাধ্যতামূলক করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
বৈঠকে আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে দলীয় হুইপ ভাঙলে সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ চলে যায়। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, অর্থবিল বাদে অন্যান্য বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। কিন্তু বিএনপি এতে দ্বিমত জানিয়ে বলেছে, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতায় এমন ছাড় দিলে সরকারের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা হুমকিতে পড়তে পারে।”
সালাহউদ্দিন বলেন, “আমরা বলেছি, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধন বিল, আস্থা ভোট এবং জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাদে অন্যান্য বিষয়ে সংসদ সদস্যরা মত প্রকাশ ও ভোট দেওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক চর্চা যদি পোক্ত হয়, তখন এই অনুচ্ছেদে আরও সংস্কারের সুযোগ তৈরি হবে।”
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি এ বৈঠকে। সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, এনসিসির বিষয়ে বিএনপি এখনো নীতিগতভাবে একমত নয়। তিনি বলেন, “এটি আমাদের দেশে নতুন ধারণা। আমাদের সংসদীয় ইতিহাসে এনসিসির কোনো প্রয়োগ নেই। এ বিষয়ে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা করেছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের নির্বাচিত সংসদে আলোচনা সাপেক্ষে হবে।”
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’-এর পুরাতন অবস্থানে ফিরে যেতে চাই। সেইসঙ্গে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ইসলামি মূল্যবোধকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে পুনঃস্থাপন করতে চাই। তবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রভিত্তিক মৌলিক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে আমরা নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছি।”
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের রূপরেখা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো একত্রিত করে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে। এটি জুলাই সনদ নামে পরিচিত হতে পারে, তবে নামকরণ ও কৌশল নির্ধারণ কমিশনের ওপর নির্ভর করবে।”
বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে সভাপতিত্ব করেন সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। উপস্থিত ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ এবং ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
সভাপতির বক্তব্যে ড. আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। অতীতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূচনাও আমরা দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করার জন্য একটি টেকসই সাংবিধানিক কাঠামো প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এই দলটি শুধু ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই নয়, বরং রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে ধারাবাহিকভাবে প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে।”
বৈঠকে সব বিষয়ে একমত না হওয়ায় আগামী রবিবার আবারও সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়। সেখানে বিচার বিভাগীয় সংস্কার ও নির্বাহী ক্ষমতার কাঠামো নিয়েও আলোচনা হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বিএনপি দলীয়ভাবে সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামোর বিষয়গুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তাদের চূড়ান্ত অবস্থান জানাবে।
জাতীয় ঐকমত্য গঠনের এই উদ্যোগ একটি দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতির ফসল। সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি টেকসই ও কার্যকর কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিএনপির অবস্থান যেখানে কিছু ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে মিলে গেছে, সেখানে কিছু বিষয়ে তারা ভিন্নমত পোষণ করেছে। এই ভিন্নমতই ভবিষ্যতের জাতীয় সংলাপ ও সাংবিধানিক চুক্তির ভিত্তি রচনায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।