বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার দাবি করবে: ১৫ বছর পর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠকে আলোচনার প্রস্তুতি
বাংলাদেশ সরকার আগামী পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানের কাছে ৪.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অঙ্কটি ১৯৭১ সালের পূর্বে বাংলাদেশের প্রাপ্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে তৎকালীন ঘূর্ণিঝড় ত্রাণ সহায়তা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, সঞ্চয়পত্র, এবং আরও কিছু আর্থিক দায়, যা পাকিস্তান আজও পরিশোধ করেনি। দীর্ঘদিনের এই আর্থিক বিরোধ এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে, কারণ দীর্ঘ ১৫ বছর পর দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের জন্য প্রাপ্ত বিদেশি ত্রাণ ও সহায়তা অর্থের একটি বড় অংশ নিজেই ব্যবহার করেছে এবং প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেয়নি। একই সঙ্গে, যারা পাকিস্তানের হয়ে চাকরি করতেন এবং ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশে থেকে যান, তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অন্যান্য সঞ্চয়পত্রের অর্থ এখনও পরিশোধ করা হয়নি। বাংলাদেশের সরকার ইতিমধ্যে এসব দাবি পূরণের জন্য প্রমাণসহ একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, যাতে আর্থিক লেনদেনের হিসাব, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার রেফারেন্স যুক্ত রয়েছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এই আর্থিক বিরোধ বিরাজমান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায়। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নানা সময়ে উত্তপ্ত থাকায় এই ইস্যু নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা সম্ভব হয়নি। তবে এবার ১৫ বছর পর যখন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে, তখন এই দাবি আবারো কেন্দ্রবিন্দুতে আসছে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, তারা পাকিস্তানের কাছে যে ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার দাবি করছে, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও দেশগুলো যে ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিল, তার বড় অংশ;
বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রাক্তন পাকিস্তানি সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পেনশন;
সঞ্চয়পত্র, ইনস্যুরেন্স, এবং ব্যাংক হিসাবের অর্থ যা পাকিস্তানে আটকে আছে;
রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ, যা কেন্দ্রীয় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জমা রেখেছিল কিন্তু ফেরত দেয়নি।
বাংলাদেশ এবার এই দাবি উত্থাপনের আগে প্রমাণের ভিত্তিতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সরকারি একাধিক সংস্থা ও গবেষক দলের সহায়তায় তৈরি হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক বিশ্লেষণ রিপোর্ট, যাতে প্রাসঙ্গিক নথি, চুক্তি, হিসাবপত্র এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক নীতিমালার ভিত্তিতে দাবি করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা পাকিস্তানের কাছে আবেগ নয়, তথ্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমাদের প্রাপ্য দাবি করছি। আন্তর্জাতিক পরিসরে এর স্বীকৃতি আদায়ে আমরা প্রস্তুত।”
এখন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। তবে অতীতে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান দাবি করে এসেছে যে, ১৯৭১-পরবর্তী আর্থিক জটিলতা দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। অনেক পাকিস্তানি বিশ্লেষক দাবি করেছেন যে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও পরবর্তী পরিস্থিতি এই ধরনের দাবি খারিজের ভিত্তি হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের দাবি অস্বীকার করা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এই আর্থিক দাবি কেবল বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে যেসব সংস্থা ঘূর্ণিঝড় ত্রাণ পাঠিয়েছিল, তারা আগ্রহভরে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ তাদের পাঠানো অর্থ ও সহায়তা যদি ভুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে তা একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে।
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে বিশ্বের নজর কেড়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি আয় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এর ফলে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী ভূমিকা নিতে পারছে। পাকিস্তানের নিকট এই আর্থিক দাবি তারই একটি বহিঃপ্রকাশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দাবি আদায়ের জন্য বাংলাদেশকে ধাপে ধাপে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক আইনি পথ অনুসরণ করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে, যদি পাকিস্তান আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে সম্মত না হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যম ছিল না, বরং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যও ছিল এক অবিস্মরণীয় লড়াই। পাকিস্তানের কাছ থেকে অর্থনৈতিক অবিচার এবং বৈষম্যের প্রতিকার পাওয়াই ছিল সেই সংগ্রামের মূল প্রেরণা। আজ যখন বাংলাদেশ সেই আর্থিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পথে আওয়াজ তুলছে, তখন সেটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে এই ইস্যুকে শুধু পাকিস্তানের সাথে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে না। সরকার চাইছে, এই দাবি আন্তর্জাতিক ফোরামেও তুলে ধরা হোক, যাতে বিষয়টির গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা আরও বিস্তৃতভাবে স্বীকৃত হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, “আমরা চাই, পাকিস্তান এই দাবি স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছার সঙ্গে বিবেচনা করুক। তবে তাতে যদি ব্যর্থ হয়, আমরা অন্যান্য কূটনৈতিক ও আইনি পথও খোলা রাখব।”
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার দাবি শুধুমাত্র একটি আর্থিক হিসেব নয়, বরং এটি জাতীয় মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এই দাবি আদায়ে যে প্রস্তুতি এবং তথ্যভিত্তিক কৌশল নেওয়া হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ এখন অতীতের ভুলে আর চোখ বুজে থাকতে রাজি নয়। বরং ইতিহাসের ঋণ ও অধিকার আদায়ে সে এখন অনেক বেশি সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী।