ইউরেনিয়াম ও সৌরশক্তিকে ঘিরে সহযোগিতা, আসছে যুগান্তকারী বিনিয়োগ
বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আরেকটি কৌশলগত অগ্রগতি ঘটাতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। রোববার (১৩ এপ্রিল) রিয়াদে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট জানান, বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহযোগিতার লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে একটি প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে। এই চুক্তি শুধু জ্বালানি খাতে নয়, বরং পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় রচনা করবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই প্রাথমিক চুক্তির লক্ষ্য সৌদি আরবে একটি বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। যুক্তরাষ্ট্র এতে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে। সৌদি আরবের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যকে চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ক্রিস রাইট জানান, চুক্তির বিস্তারিত তথ্য ও কার্যপন্থা বছরের শেষ দিকে প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে আলোচনার পর্যায়ে থাকা এই উদ্যোগটি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব ও উপস্থিতি আরও জোরদার করতে পারে।
সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই তাদের অর্থনীতি এবং জ্বালানি উৎপাদন ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাণিজ্যিক পারমাণবিক শক্তি একটি কৌশলগত অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে সৌদি আরব পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে চায়। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জ্বালানির নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি শক্তিশালী হবে।
মার্কিন জ্বালানি সচিব সৌদি আরবের ইউরেনিয়াম মজুদ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদকে ‘প্রাকৃতিক সুবিধা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই সম্পদগুলো দেশটিকে আত্মনির্ভরশীল পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনে সহায়তা করবে। এতে চুক্তির আওতায় গবেষণা, খনিজ উত্তোলন, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
পারমাণবিক শক্তির পাশাপাশি সৌদি আরবের সৌরশক্তি খাতও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে। রিয়াদের প্রচণ্ড সূর্যালোক এবং বিস্তৃত মরুভূমি অঞ্চল সৌর প্রযুক্তির বিকাশের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মার্কিন সচিব এই খাতে কাজ করার অবারিত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, “সৌরশক্তিতে একসঙ্গে কাজ করার অনেক বড় সুযোগ রয়েছে।”
চুক্তির রাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্বও কম নয়। ক্রিস রাইট বলেন, “আমি বিশ্বাস করি সৌদি আরব হবে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগকারী শীর্ষ দেশগুলোর একটি।” তিনি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে “উভয় পক্ষের জন্য বিজয়” হিসেবে অভিহিত করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত চাল হতে পারে। অন্যদিকে সৌদি আরবও বৈচিত্র্যময় কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের আন্তর্জাতিক প্রভাব আরও বাড়াতে চায়।
চুক্তির সম্ভাব্য কাঠামোতে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর: শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার, নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতি।
- ইউরেনিয়াম উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ: সৌদি আরবে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের জন্য যৌথ উদ্যোগে গবেষণা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন।
- বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ অবকাঠামো: নতুন পারমাণবিক প্লান্ট নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা।
- মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ: সৌদি প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণের জন্য মার্কিন সহায়তা।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানির সঙ্গে সমন্বয়: সৌর ও বায়ু শক্তিকে সমান্তরালভাবে উন্নয়ন করার পরিকল্পনা।
যদিও এই চুক্তি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে গৃহীত হচ্ছে, তবুও ইরান, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া এড়ানো যাচ্ছে না। পারমাণবিক প্রযুক্তির বিস্তার এবং সামরিকীকরণ না ঘটানোর নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়বে।
বিশ্বব্যাপী শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো সৌদি আরবের এই উদ্যোগকে কৌতূহল ও সতর্কতার মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় দেখছে। মার্কিন-কর্তৃত্বাধীন পারমাণবিক প্রযুক্তি ট্রান্সফার ইস্যুতে কংগ্রেস, আইএইএ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনুমোদনও প্রয়োজন হবে।
তবে চুক্তিটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে তা শুধু সৌদি আরব নয়, বরং সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। এতে টেকসই জ্বালানি, নতুন কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য অর্জনের পথ উন্মুক্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যকার প্রস্তাবিত এই পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি শুধু দুই দেশের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা এবং ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছর শেষের দিকে বিস্তারিত ঘোষণা আসার আগে পর্যন্ত বিশ্ব কূটনৈতিক মহল এই চুক্তির দিকে নজর রাখবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এই চুক্তির ফলে সৌদি আরব জ্বালানির নতুন দিগন্তে পা রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার কৌশলগত অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারবে—এমনটাই প্রত্যাশা করছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল।