একদিনের ব্যবধানে বদল: আবারও কমলো স্বর্ণের দাম
দেশের স্বর্ণবাজারে আবারও দেখা গেল দামের হেরফের। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) এবার ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল (রোববার) সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাজুস জানায়, দেশের বাজারে তেজাবি স্বর্ণের দাম কমার প্রেক্ষিতে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কার্যকর হবে ১৪ এপ্রিল (সোমবার) বা পহেলা বৈশাখ থেকে।
এই পরিবর্তনের ফলে ২২ ক্যারেটের এক ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৩৮ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭৬ টাকা।
স্বর্ণের নতুন মূল্য তালিকা (কার্যকর: ১৪ এপ্রিল, ২০২৫)
ক্যারেট | নতুন মূল্য (টাকা) | পূর্ববর্তী মূল্য (টাকা) | পরিবর্তন |
---|---|---|---|
২২ ক্যারেট | ১,৬২,১৭৬ | ১,৬৩,২১৪ | ⬇ ১,০৩৮ |
২১ ক্যারেট | ১,৫৪,৮০৫ | ১,৫৫,৭৯৬ | ⬇ ৯৯১ |
১৮ ক্যারেট | ১,৩২,৬৯০ | ১,৩৩,৫৪১ | ⬇ ৮৫১ |
সনাতন | ১,০৯,৫৩৭ | ১,১০,২৭১ | ⬇ ৭৩৪ |
বাজুস জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের দাম কমে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য রক্ষার্থেও এই সমন্বয় জরুরি ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে স্বর্ণের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়, যা সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে। পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবমুখর সময়ে দাম কমায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বলে জানিয়েছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
স্বর্ণের নির্ধারিত দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ সরকার-নির্ধারিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং বাজুস নির্ধারিত ৬ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি যোগ করতে হবে। তবে গহনার ডিজাইন, মান ও নকশা ভেদে মজুরির তারতম্য হতে পারে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। ফলে একজন ক্রেতার জন্য মোট ক্রয়মূল্য নির্ভর করবে নির্বাচিত গহনার ওপর।
এই নিয়ে ২০২৫ সালে মোট ২১ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করল বাজুস। এর মধ্যে ১৫ বার দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ৬ বার কমানো হয়েছে।
২০২৪ সালের চিত্রটিও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ওই বছর ৬২ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৩৫ বার দাম বাড়ানো হয় এবং ২৭ বার কমানো হয়।
এই ধারা থেকেই বোঝা যায়, স্বর্ণবাজারে ক্রমাগত দামের ওঠানামা এখন একটি স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাজার, ডলার রেট এবং ভোক্তা চাহিদার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
স্বর্ণের দামে হেরফের হলেও রুপার দামে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বর্তমানে রুপার দাম নিম্নরূপ:
ক্যারেট | রুপার দাম (টাকা/ভরি) |
২২ ক্যারেট | ২,৫৭৮ |
২১ ক্যারেট | ২,৪৪৯ |
১৮ ক্যারেট | ২,১১১ |
সনাতন | ১,৫৮৬ |
বিশ্লেষকদের মতে, রুপার চাহিদা ও সরবরাহ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকায় এ খাতে দামের ওঠানামা স্বর্ণের তুলনায় অনেক কম।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্বর্ণের দামে বারবার পরিবর্তন সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিশেষ করে বিয়ে, উৎসব কিংবা উপহার সামগ্রী হিসেবে স্বর্ণ কেনা মানুষদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের মতে, এই পরিবর্তন বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দরপতন, ডলার বিনিময় হারের পরিবর্তন এবং দেশের অভ্যন্তরে চাহিদার পরিবর্তন – এই তিনটি কারণকে মূল হিসেবে দেখছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে স্বর্ণের দাম কিছুটা নিম্নমুখী, ফলে আমদানি ব্যয় কমেছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উদ্বেগ হ্রাস পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমাচ্ছেন, যার প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়ছে।
বাজুস সূত্রে জানা গেছে, ভবিষ্যতে মূল্য নির্ধারণ আরও স্বচ্ছভাবে করতে একটি কেন্দ্রীয় মূল্য পর্যবেক্ষণ ইউনিট গঠন করা হতে পারে। পাশাপাশি, স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করার ব্যাপারেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আলোচনায় রয়েছেন।
স্বর্ণের দাম স্থিতিশীল থাকলে সাধারণ ক্রেতারা দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবেন এবং বাজারে আস্থা ফিরবে।
ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, “মাত্র একদিন আগেই স্বর্ণ কিনেছেন এমন অনেক ক্রেতা এখন ক্ষুব্ধ। তবে আমরা দামের তারতম্য নিয়ে কিছু করতে পারি না। আমাদের হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।”
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা গৃহবধূ জেসমিন আক্তার বলেন, “পহেলা বৈশাখে গহনা কেনার পরিকল্পনা ছিল, আগের দিন দাম বেড়েছে শুনে ভয় পেয়েছিলাম। এখন দাম কমেছে জেনে ভালো লাগছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা স্বর্ণে বিনিয়োগ করেন, তাদের জন্য এখনই চটজলদি সিদ্ধান্ত না নিয়ে অপেক্ষা করাই ভালো। কারণ বাজারে অস্থিরতা রয়েছে এবং দাম আরও পরিবর্তন হতে পারে।
তবে যারা গহনা কেনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, তাদের জন্য এখন একটি সুযোগ হতে পারে কমদামে কেনার। বিশেষ করে উৎসবের সময় স্বর্ণের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়, ফলে দাম আবারও বাড়তে পারে।
স্বর্ণের দাম কমানোতে বাজারে একধরনের স্বস্তি ফিরেছে, বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে। তবে বারবার দামের পরিবর্তন সাধারণ ভোক্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা তৈরি করছে। এ অবস্থায় বাজুসের আরও সুসংহত ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের দাবি ক্রেতা এবং ব্যবসায়ী—উভয় পক্ষ থেকেই উঠছে।
স্বর্ণের মতো একটি উচ্চমূল্যবান পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হলে দেশের অর্থনীতিতেও এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।