চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে তিনটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে চীনের অর্থায়নে তিনটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে। ২০২৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর এই তথ্য জানান। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে, নীলফামারী, সাভার ধামরাই ও চট্টগ্রামে এই তিনটি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে এবং এর কিছু কার্যক্রম ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। একদিকে যেমন রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর আধুনিকায়নের মাধ্যমে সার্বিক স্বাস্থ্যখাতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, নীলফামারীতে এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ১৬ একরের একটি জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই জমির দায়িত্ব ও পর্যবেক্ষণ বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি শাখা দেখাশোনা করছে।
এই হাসপাতালটি উত্তরাঞ্চলের জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন। কারণ, রাজধানী থেকে দূরত্ব এবং সীমিত সংখ্যক উন্নত চিকিৎসা সুবিধার কারণে এই অঞ্চলের মানুষকে বহু কষ্ট করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা চট্টগ্রামমুখী হতে হয়। এই হাসপাতাল নির্মিত হলে স্থানীয় জনগণ তাদের নিজ এলাকায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
চীনের সহায়তায় দ্বিতীয় যে হাসপাতালটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটি সাভারের ধামরাই এলাকায়। এটি হবে একটি পূর্ণাঙ্গ পূর্ণবাসন কেন্দ্র, যেখানে দুর্ঘটনায় আহত, পঙ্গু, বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে পূর্ণবাসনমূলক চিকিৎসা কেন্দ্র খুবই সীমিত এবং মানসম্পন্ন সেবার ঘাটতি রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সেই ঘাটতি পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। ভবিষ্যতে এই কেন্দ্র থেকে শুধু দেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সেবা রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
তৃতীয় হাসপাতালে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে। এটি হবে ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। যদিও প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে আলোচনার ভিত্তিতে এটি চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে।
চট্টগ্রামে ইতিমধ্যেই চীনের অর্থায়নে একটি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট পরিচালিত হচ্ছে, যা অত্যন্ত সফলভাবে চলছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন হাসপাতালটি হলে তা চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে চীনের মতো দেশের সহায়তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইতোমধ্যেই দৃঢ়, এবং এই স্বাস্থ্য খাতভিত্তিক প্রকল্পগুলো সেই সম্পর্ককে আরও মজবুত করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তিনটি হাসপাতাল শুধু স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নেই ভূমিকা রাখবে না, বরং দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং চিকিৎসা খাতে গবেষণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে।
এই তিনটি হাসপাতাল নির্মাণের খবরে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নীলফামারী ও সাভার অঞ্চলের বাসিন্দারা মনে করছেন, চিকিৎসা নিতে আর ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ছুটতে হবে না। অনেকেই আশা করছেন, এই প্রকল্পগুলো যথাযথ সময়মতো সম্পন্ন হলে স্বাস্থ্য খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
বর্তমান স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলো ছাড়াও ভবিষ্যতে আরও কিছু যৌথ প্রকল্প নিয়ে কাজ করার ইঙ্গিত মিলেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং চীনা প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে চীনের এই বিনিয়োগ কেবল অবকাঠামো উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তি স্থানান্তর, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং গবেষণায়ও সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে চীনের সহায়তায় তিনটি বড় হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই হাসপাতালগুলো নির্মাণ সম্পন্ন হলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে, যা জনগণের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ চিকিৎসক এবং বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এই মহতী উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে বিশ্বের মানচিত্রে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।