ডিবি প্রধান রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হলো
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোববার, ১৩ এপ্রিল, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর স্বাক্ষর করা এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এই রদবদলের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সম্প্রতি আলোচিত মডেল মেঘনা আলমকে আটক করার ঘটনাটি।
গত সোমবার, ৭ এপ্রিল, ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ খেতাবপ্রাপ্ত মডেল মেঘনা আলমকে তার ঢাকার বাসা থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তীব্র আলোচনার জন্ম দেয়। এরপর ১০ এপ্রিল রাতে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় তাকে ৩০ দিনের জন্য আটক রাখার নির্দেশ দেন।
ডিবি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, “আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই মেঘনাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাকে অপহরণের অভিযোগ সঠিক নয়।” ডিএমপির পক্ষ থেকে ১১ এপ্রিল একটি ব্যাখ্যামূলক বিবৃতি প্রকাশ করা হয় যেখানে উল্লেখ করা হয়, মেঘনার প্রতি কোনো অবৈধ আচরণ করা হয়নি এবং আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার তার রয়েছে।
তবে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটি একপ্রকার ভাইরাল ইস্যুতে পরিণত হয়। নাগরিক সমাজ, শিল্পী সমাজ ও রাজনীতিবিদদের একাংশ মেঘনার আটককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দেন। এই প্রেক্ষাপটে ডিবিপ্রধানের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
যদিও সরকারিভাবে রেজাউল করিম মল্লিককে পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মেঘনা আলমকে আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ সিদ্ধান্ত এসেছে।
পুলিশ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সূত্রগুলোও জানান, ডিবিপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে ডিএমপি কমিশনার দফায় দফায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে এবং জনগণের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছাতে এই রদবদল জরুরি ছিল।
রেজাউল করিম মল্লিক ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। তিনি ১৭তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের কর্মকর্তা। তাঁর কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ও বিভিন্ন মেট্রোপলিটন ও জেলা ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ডিবির প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)-র প্রধানের পদটি এক মাস ফাঁকা ছিল।
ডিবি’র ব্যাখ্যায় বলা হয়, মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে, এই আইন প্রায়শই সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ।
বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশেষ ক্ষমতা আইন একটি বিতর্কিত আইন এবং এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন। এই আইনে আটক রাখার জন্য বিশেষ অনুমতি ও পর্যাপ্ত কারণ থাকা বাধ্যতামূলক।
ডিবি পুলিশ বাংলাদেশ পুলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ঢাকা মহানগরীর গোয়েন্দা নজরদারি, অপরাধ তদন্ত, সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব এদের ওপর। ডিবির নেতৃত্ব পরিবর্তনের ফলে গোয়েন্দা শাখার ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে নতুন ডিবিপ্রধান হিসেবে কাকে দায়িত্ব দেয়া হবে তা এখনো জানানো হয়নি। তবে ডিএমপির পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, একজন অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা এই পদে আসছেন, যিনি ডিবির কাজকে আরও কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য করবেন।
মেঘনা আলমের আটক ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে বলছেন, তার মতো একজন পরিচিত মডেলকে প্রকাশ্যে বাসা থেকে তুলে নেয়ার ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনি প্রক্রিয়া মেনে ব্যবস্থা নেয়া হলে তাতে আপত্তির কোনো কারণ নেই, কিন্তু সেই আইনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
পুলিশ বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এই ধরণের বিতর্কিত ঘটনা রোধ করা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ডিবিপ্রধানের পদে পরিবর্তন প্রশাসনিক জবাবদিহিতার একটি ধাপ বলে অনেকেই মনে করছেন। তবে এর স্থায়ী সমাধান পেতে হলে শুধু ব্যক্তি পরিবর্তন নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এখন দেখার বিষয়, নতুন নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যক্রমে কতটা স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত হয় এবং মেঘনা আলমের আটক ইস্যু শেষ পর্যন্ত কোন পরিণতির দিকে যায়।