নদীপথে এক মহান অভিযান: সাঁতারের ছন্দে বাংলার হৃদয়ে
বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূখণ্ডে এমন এক অভাবনীয় অভিযানের সাক্ষী হলো মানুষ, যেখানে কায়াক আর সাঁতারের সমন্বয়ে এক অভিযাত্রী পাড়ি দিলেন ব্রহ্মপুত্র থেকে বঙ্গোপসাগরের তীর পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জলপথ। এই সাহসী উদ্যোগের নাম—“দ্য গ্রেট ডেলটা সুইম”। ভ্রমণসঙ্গী কখনো কায়াক চালিয়ে, কখনো পাশে পাশে সাঁতরে, আর কখনো উত্তাল নদীর বুক চিরে সাহসী ভঙ্গিতে সাঁতারু এগিয়ে গেছেন তাঁর গন্তব্য নিঝুম দ্বীপের দিকে। এই অভিযানের প্রতিটি ধাপে ছিল উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জ, আর মানুষের মানবিকতা—যা একে পরিণত করেছে এক অনন্য অনুপ্রেরণার গল্পে।
পরিকল্পনা চলছিল অনেকদিন ধরে। উদ্দেশ্য ছিল ব্রহ্মপুত্রের প্রবেশমুখ থেকে ধাপে ধাপে সাঁতরে পৌঁছানো বঙ্গোপসাগরে। সেই লক্ষ্যেই ২০২৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অভিযান শুরু হয় কুড়িগ্রামের ঝুনকার চর থেকে। সঙ্গী ছিলেন নওশাদ নওয়াজ, একটি ইনফ্ল্যাটেবল কায়াকে দুজনে মিলে অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নেন। প্রথম রাতেই স্থানীয় এক বাসিন্দার আতিথেয়তায় কাটে তাঁদের প্রথম রাত।
ঝুনকার চর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ব্রহ্মপুত্র। এখানকার নীলাভ জলে নামার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযাত্রীর মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। সাঁতারের প্রতি তার অন্তর্নিহিত টান যেন তাকে আহ্বান করে। সঙ্গীর সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়—তিনি সাঁতরাবেন আর নওশাদ কায়াক চালাবেন।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হয় জলযাত্রা। দুই ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৮ কিলোমিটার সাঁতরে বিশ্রাম নেওয়া হয় এক ঘাটে। সেখানেই এক দোকানে খাওয়া হয় নদীর মাছ দিয়ে তৈরি তরকারি।
সেদিন আরও ১৩ কিলোমিটার সাঁতরে তাঁরা পৌঁছান উলিপুরের গুজিমারি চরে। উৎসুক জনতার ভিড় তাঁদের ঘিরে ফেলে। সবাই জানতে চায়, এতটা পথ সাঁতরে কীভাবে এলেন, ভয় করেনি? স্থানীয় এক নারী নিজ উদ্যোগে তাঁদের নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। গ্রামের সরলতা, আন্তরিকতা আর আপ্যায়নের চিত্র যেন নতুন করে মনে করিয়ে দেয় বাংলার হৃদয়কে।
দুই দিনের সাঁতারের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় ফিরে যান অভিযাত্রী। এরপর তিন দিন ধরে পরিকল্পনা করে আবার ফিরে আসেন চিলমারীতে। সঙ্গে যুক্ত হয় অভিযানপ্রিয় সংগঠন ‘অভিযাত্রী’র স্বেচ্ছাসেবক দল।
এই পর্যায়ে সাঁতারের সঙ্গী হন চিকিৎসক সাফকাত ফারুক। ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে তাঁরা পেরিয়ে যান চর কাপাসিয়া, বালাসিঘাট, মুন্সিরহাট, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ। কখনো নদীর গভীরতা কমে আসে, কখনো আবার জলের স্রোত এতটাই প্রবল হয় যে থই পাওয়া যায় না।
১৩ মার্চ যমুনা সেতু পেরোনোর পর নদী হয়ে ওঠে আরও প্রশস্ত ও গভীর। দীর্ঘপথ সাঁতরে যাওয়ার কষ্ট উপশম করতে এবার সঙ্গী করা হয় একটি বড় নৌকা। এতে বিশ্রাম, খাবার, আর জরুরি সহায়তার ব্যবস্থা থাকে। চৈত্রের সোনালি রোদে বারবেলা চর, কালিগঙ্গা নদীর উৎসমুখ, দৌলতদিয়ার প্রমত্ত মোহনা পেরিয়ে যেতে হয় তাঁকে।
একদিন আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়, দিগন্তে বাজ পড়ে, আর প্রমত্ত পদ্মা যেন জেগে ওঠে ভয়ংকর রূপে। কায়াক ও নৌকা নিরাপদ আশ্রয়ে গেলে অভিযাত্রী একাই রয়ে যান জলের মধ্যে। সাঁতরের শক্তি আর ধৈর্যের পরীক্ষা চলতেই থাকে।
২২ মার্চ, অভিযানপথের ১৯তম দিনে পৌঁছান চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনায়। তিন দিন পর ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসে আবার শুরু হয় সাঁতার। এবার লক্ষ্য মেঘনা ও সাগরের মুখ।
মেঘনা নদীর ভারী ও লোনা জল সাঁতরানো আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ভাটার সময় ধরে পরিকল্পনা করতে হয়। মাঝে মাঝে এমন হয়, দেড় ঘণ্টা সাঁতরেও এক মিটারও সামনে এগোতে পারেন না, বরং পিছিয়ে যেতে হয়।
২৭ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত হিজলা, ইলিশা, চৌমুহনী হয়ে সাঁতরে পৌঁছান হাতিয়া চ্যানেল। ৩১ মার্চ শুরু হয় চূড়ান্ত দিনের সাঁতার—লক্ষ্য নিঝুম দ্বীপ।
সমুদ্রের ঢেউ আর ভাটার প্রবল টান কায়াক ও সাঁতারুকে একত্রে রাখতে দেয় না। এমন সময় ২০০-৩০০ ফুট পরপর থাকে প্রাণঘাতী বেহুন্দি জাল। এসব জালে আটকে গেলে জীবনের ঝুঁকি তীব্র। সৌভাগ্যবশত বারবার সে ফাঁদ এড়িয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন অভিযাত্রী।
অবশেষে সাঁতরাতে সাঁতরাতে পৌঁছান হাতিয়ার দক্ষিণে। দেখা যায় নিঝুম দ্বীপের শ্যামল ছায়া। স্রোতের রং, গন্ধ, উত্তাপ সব বদলে যায়। জল হয়ে ওঠে ঘোলা ও উষ্ণ।
নিঝুম দ্বীপের তীরে পৌঁছে তাঁর হাত ছোঁয়ায় নরম পলিমাটিতে। দূর থেকে ছুটে আসে অভিযাত্রীর পতাকা হাতে এক সঙ্গী। আনন্দে ভরে ওঠে চারদিক। ‘দ্য গ্রেট ডেলটা সুইম’-এর ৪০০ কিলোমিটার সাঁতার সম্পন্ন হয় সফলভাবে।