অভিযুক্ত নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে মাঠে নামছে দুদক
রাজশাহী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, বেঞ্চ সহকারী মো. নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণসহ একাধিক গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। রাজপাড়া থানায় দায়েরকৃত এই অভিযোগের সূত্র ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে বিষয়টি অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল সকালে, যখন আদালতের নেজারত বিভাগের কর্মরত কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসেন একটি ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে জানতে পারেন, নজরুল ইসলাম জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের বেলবন্ড দাখিলের সময় প্রত্যক্ষভাবে ঘুষ গ্রহণ করছেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অভিযোগকারী মো. মোশারফ হোসেন যে ভিডিও ক্লিপের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, একাধিক জামিনপ্রাপ্ত আসামির পক্ষ থেকে বেলবন্ড দাখিলের সময় মো. নজরুল ইসলাম প্রত্যেকের নিকট থেকে নগদ ৪০০ টাকা করে ঘুষ নিচ্ছেন। এই ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আদালতের বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ওই একই দিনে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে আদালতের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নানা অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ উপার্জন করে আসছেন।
বিশেষ করে জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের নথি এজলাসে উপস্থাপন, বেলবন্ড গ্রহণ এবং জাবেদা নকলের জন্য নথি নকলখানায় প্রেরণের ক্ষেত্রে তিনি ঘুষ দাবি করেন এবং অর্থ না পেলে প্রক্রিয়া বিলম্বিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, মো. নজরুল ইসলাম নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা ঘুষ আদায় করেন। এসব অর্থ তিনি বিভিন্ন মামলার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংগ্রহ করেন।
যদিও সরকারি দফতরে কাজ সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে, নজরুল ইসলাম ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে আদালতের নিয়মনীতি ভঙ্গ করে আসছিলেন বলে অভিযোগকারীর দাবি।
এ বিষয়ে আদালত কর্তৃপক্ষও নীরব থাকে নি। অভিযোগ দায়েরের পরপরই আদালত প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভাগীয় তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অভিযুক্ত নজরুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
আদালতের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আদালতের অভ্যন্তরীণ তদন্ত ছাড়াও বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অধীন তফসিলভুক্ত অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, সরকারি অনুমোদনের ভিত্তিতে পুরো বিষয়টি এখন দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তাধীন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তারা যথাযথভাবে ভিডিও ক্লিপ, সংবাদ প্রতিবেদন এবং আদালতের নথিপত্র যাচাই করে তদন্ত কাজ শুরু করবে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আদালতের মতো একটি মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন দুর্নীতির অভিযোগ তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের একটি বড় অংশের মত, শুধুমাত্র নজরুল ইসলাম নয়, যেসব কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে এই অনিয়মের বিষয়ে অবগত থেকেও ব্যবস্থা নেননি, তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হওয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরণের দুর্নীতির ঘটনায় আদালতের প্রশাসনিক তদারকির দুর্বলতাও দায়ী। দীর্ঘদিন ধরেই বেঞ্চ সহকারীর মতো পদে কর্মরতরা অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিচারপ্রার্থীদের নিকট থেকে সুবিধা আদায়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আসছেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এটি নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ নয়। অতীতেও বিভিন্ন সময় মৌখিকভাবে তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছিল, তবে লিখিতভাবে অভিযোগ না আসায় তা তদন্তের পর্যায়ে যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেহেতু অভিযোগকারী একই আদালতের কর্মকর্তা, তাই তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও চাকরি সংক্রান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদি এমন অভিযোগ দায়েরের কারণে তার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে দুর্নীতি উন্মোচনে কেউ আর সাহসী হয়ে উঠবে না।
এই ঘটনার ভিডিও এবং সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হবার পর নেটিজেনদের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, “বিচার প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় মানে ন্যায়বিচার বিক্রি করা।”
জনগণের চাপ এবং সংবাদমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকার কারণে বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়েও পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত বেঞ্চ সহকারী মো. নজরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেননি।
রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট মনিরুল ইসলাম বলেন, “আমরা চাই, আদালতের মর্যাদা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।”
এই ঘটনায় শুধুমাত্র একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, বরং তা পুরো বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার প্রশ্ন। যদি সঠিক তদন্ত এবং উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ হতে পারে।
বিচারপ্রার্থীদের কাছে ন্যায়বিচার পেতে যে বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন, সেটি টিকিয়ে রাখতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন প্রতিটি অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা সময়ের দাবি। এখন সময় এসেছে, দায়ী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে উদাহরণ সৃষ্টি করার