ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত মাহফুজুর রহমানের শোকার্ত পরিবারের প্রগাঢ় বেদনার দিন
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা ৮ মিনিট। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসছে। চারদিকে উৎসবের আমেজ, কারও মুখে ক্লান্তির ছাপ, কারও চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এই উচ্ছ্বাসের ভিড়েই বাগেরহাট প্রেসক্লাবের ব্যালকনিতে হঠাৎ করেই ছিন্ন এক দৃশ্য। এক নারী চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে আকস্মিকভাবে এক সংবাদকর্মীর হাত ধরে কেঁদে ওঠেন—‘সবাইর ছেলে-মেয়ে পরীক্ষা দিলো, কিন্তু আমার মাহফুজ তো দিলো না!’
সেই নারীর নাম বেগম, যিনি আজ তাঁর একমাত্র ছেলে মো. মাহফুজুর রহমানকে হারিয়ে বুক ফাটিয়ে কাঁদছেন। মাহফুজ চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকার মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যান এই ১৬ বছরের কিশোর।
মাহফুজের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের গুলিশাখালী গ্রামে। তিন মেয়ের পর একমাত্র ছেলে মাহফুজ ছিল পরিবারের চোখের মণি। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী এই কিশোর চলতি বছর আলহাজ আব্বাস উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
কিন্তু ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার জুমার নামাজে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি মাহফুজ। সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যুর খবর পায় পরিবার। পরদিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তাঁর নিথর দেহ খুঁজে পান বাবা-মা।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে মাহফুজ নিহত হন। পরিবারের ভাষ্য মতে, সে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ছিল না—শুধু এলাকার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের অংশ ছিল। এভাবে একজন পরীক্ষার্থী কীভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহত হলো—সেই প্রশ্ন আজও অনুত্তরিত।গুলিশাখালী গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে মাহফুজকে দাফন করা হয়। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, স্কুলের বন্ধুবান্ধব কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না—আর কখনো মাহফুজ ফিরবে না।
মানবাধিকার কর্মীরা এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একজন মানবাধিকার পর্যবেক্ষক বলেন, “একজন শিক্ষার্থী যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে আমাদের সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে তা ভেবে দেখা উচিত।”
স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, “মাহফুজ ভালো ছাত্র ছিল। তার মতো ছেলেরা জাতির ভবিষ্যৎ। আমরা তাকে হারিয়েছি, কিন্তু একইসঙ্গে আমরা হারিয়েছি আমাদের বিবেক।”
১. কাদের গুলিতে নিহত হলো মাহফুজ?
২. কীভাবে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হলো?
৩. তদন্ত কতদূর এগিয়েছে?
৪. পরিবার কোনো ধরনের সহায়তা পেয়েছে কি না?
এই প্রশ্নগুলো আজও মীমাংসার অপেক্ষায়।
আজ যখন হাজারো শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে হাজির হলো, তখন এক মায়ের বুক হাহাকার করে উঠলো—‘আমার ছেলেও তো পরীক্ষার্থী ছিল।’ কিন্তু সেই পরীক্ষা দেওয়া হলো না। গুলির আঘাতে, রাষ্ট্রের নির্মমতায়, এক ছাত্রের জীবন থেমে গেল।
এই প্রতিবেদন কোনো রাজনীতি নয়, এটি এক মায়ের কান্নার প্রতিধ্বনি, এক বাবার নিরব প্রতিবাদ, এবং আমাদের সমাজের অমানবিক দৃষ্টান্তের স্মারক।