পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে: নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচিত পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নিয়োগকে ঘিরে পাঁচ বছর ধরে চলমান আইনি লড়াইয়ের অবসান ঘটেছে। হাইকোর্ট ২০২০ সালের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে গৃহীত নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসের মধ্যে মনোনয়নপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের এই রায়ের ওপর কোনো স্থগিতাদেশ না দিয়ে ‘নো অর্ডার’ দেওয়ায় রায় এখন কার্যকর বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এই রায় কেবল একদল চাকরিপ্রার্থী বা একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের প্রশ্ন নয়—এটি ন্যায়বিচার, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা এবং জনস্বার্থ রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
২০২০ সালের ১০ মার্চ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ১ হাজার ৮০টি পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের এই নিয়োগে দেশব্যাপী বিপুলসংখ্যক আবেদন জমা পড়ে। প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের কথা ছিল।
প্রার্থীদের মধ্যে থেকে ২০২৩ সালের ১১ মে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ৭ হাজার ৬২১ জন। তারা ২৫ মে থেকে ১৮ জুন ২০২৩ পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা শেষ হলেও, এর ফল প্রকাশ না করে ২০২৪ সালের ১৪ জানুয়ারি একটি নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা প্রশিক্ষণার্থীদের মনোনয়নপ্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। এই ঘোষণায় নিয়োগপ্রত্যাশীদের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
প্রশিক্ষণার্থী মনোনয়নপ্রক্রিয়া বাতিলের বিরুদ্ধে চারটি পৃথক রিট করেন প্রার্থীরা। এসব রিটের প্রাথমিক শুনানিতে হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। এরপর চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে।
২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই বেঞ্চ রুল নিষ্পত্তি করে রায় দেন এবং তাতে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসের মধ্যে মনোনয়নপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে এই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে লিভ টু আপিল আবেদন করে। কিন্তু ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ চেম্বার আদালত আবেদনটির শুনানি শেষে ‘নো অর্ডার’ দেন। এর ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে এবং তা বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।
হাইকোর্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেন, “২০২০ সালের ১০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে অনেক প্রার্থীর বয়সসীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, ফলে তাদের সরকারি চাকরির শেষ সুযোগও হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন বাস্তবতায় নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা সরকারের দায়িত্ব।”
রায়ে আরও বলা হয়, “পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার ভূমিকা শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় এই পদের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুর জন্মকালীন সময় ও প্রসব-পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই পদগুলো শূন্য থাকা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।”হাইকোর্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেন, “২০২০ সালের ১০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে অনেক প্রার্থীর বয়সসীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, ফলে তাদের সরকারি চাকরির শেষ সুযোগও হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন বাস্তবতায় নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা সরকারের দায়িত্ব।”
রায়ে আরও বলা হয়, “পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার ভূমিকা শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় এই পদের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুর জন্মকালীন সময় ও প্রসব-পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই পদগুলো শূন্য থাকা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।”
নিয়োগ প্রক্রিয়ার আদ্যোপান্ত
ধাপ | সময়সীমা | বিবরণ |
---|---|---|
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০২০ | পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি |
লিখিত পরীক্ষার ফল | ১১ মে ২০২৩ | ৭,৬২১ জন উত্তীর্ণ |
মৌখিক পরীক্ষা | ২৫ মে – ১৮ জুন ২০২৩ | সকল উত্তীর্ণদের অংশগ্রহণ |
মনোনয়নপ্রক্রিয়া বাতিল | ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ | নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রক্রিয়া বাতিল |
হাইকোর্টের রায় | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | মৌখিক পরীক্ষা ও নিয়োগের নির্দেশ |
আপিল বিভাগের রায় | ২৫ মার্চ ২০২৫ | ‘নো অর্ডার’—হাইকোর্টের রায় বহাল |
বিভিন্ন মহলের মতে, এই ঘটনায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে একটি নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া, প্রার্থীদের বারবার ভোগান্তির শিকার হওয়া এবং শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের সেবা কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত এই ধরনের নিয়োগপ্রক্রিয়াগুলোকে সময়মতো সম্পন্ন করা এবং জনস্বার্থে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। নয়তো রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকাদের অবদান অনস্বীকার্য। গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রচার এবং মা ও শিশুর পুষ্টির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া—এই সবকিছুতেই তাদের ভূমিকা অপরিহার্য।
যত দ্রুত এই পদগুলোতে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তত দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শক্তিশালী হবে। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন কৌশলের সফল বাস্তবায়নের জন্য এই নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী অনেক প্রার্থী ২০২০ সাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বয়সসীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের শেষ সরকারি চাকরির সুযোগটি হারানোর আশঙ্কায় ছিলেন। হাইকোর্টের এই রায় তাদের জন্য শুধুমাত্র আইনি বিজয় নয়—বরং এটি একটি মানবিক স্বস্তির নিদর্শন।এই রায়ের পর এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ওপর দায়িত্ব পড়েছে নির্দেশ বাস্তবায়নের। মৌখিক পরীক্ষা আয়োজন, মূল্যায়ন, ফল প্রকাশ এবং প্রশিক্ষণার্থী মনোনয়ন—এই পুরো প্রক্রিয়া তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ স্পষ্টভাবে রয়েছে।
এখন দেখার বিষয়—এই সময়সীমার মধ্যে সরকার কতটা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে রায় বাস্তবায়ন করে।পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘ আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা শেষে হাইকোর্টের রায়ে প্রার্থীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেমন নিয়োগপ্রত্যাশীদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তেমনি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরো কার্যকর হবে।
সামগ্রিকভাবে এই ঘটনা প্রশাসনের জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনস্বার্থ রক্ষায় একটি নজির হয়ে থাকবে।