শিশু নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার ‘ক্রিম আপা’: ভিডিও কনটেন্টের আড়ালে নির্মমতা
বাংলাদেশের অনলাইন দুনিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো কনটেন্ট নির্মাতা ও বিউটি ক্রিম ব্যবসায়ী শারমিন শিলা ওরফে ‘ক্রিম আপা’কে নিয়ে দেশজুড়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক ও তাকে ঘিরে গৃহীত আইনি পদক্ষেপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওর সূত্র ধরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং বর্তমানে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি ভাইরাল ভিডিও থেকে, যেখানে দেখা যায় শারমিন তার কন্যা সন্তানকে জোরপূর্বক খাবার খাওয়াচ্ছেন। শিশুটির অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে খাবার গুঁজে দেওয়ার এই ভিডিও নেটিজেনদের হৃদয় স্পর্শ করে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
২০২৫ সালের ৩ মার্চ, শারমিন শিলার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, তিনি জোর করে তার কন্যা সন্তানকে কেক জাতীয় একটি খাবার খাওয়াচ্ছেন। শিশুটি খেতে অনিচ্ছুক হওয়ায় শারমিন এক হাতে তার মুখে চাপ দিয়ে অন্য হাতে খাবার মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। শিশুটির অসহায় ও কষ্টকর অভিব্যক্তি ভিডিওটি আরো হৃদয়বিদারক করে তোলে।
এই ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিশুবিষয়ক অধিকারকর্মী এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শারমিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়।
ঘটনার জেরে ৯ এপ্রিল ২০২৫ সালে আশুলিয়া থানায় শারমিন শিলার বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার ভিত্তিতে পরদিন, ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, সাভার এলাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তাকে বর্তমানে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শারমিন শিলা শুধু মাতৃসুলভ আচরণ থেকে দূরে ছিলেন না, বরং তার আচরণে ছিল নির্মমতা ও অবজ্ঞা। ভিডিওগুলোতে তার মেয়ে প্রায়ই ভয় পেতে দেখা গেছে। কখনও চুপচাপ বসে থাকছে, কখনও অকারণে কান্না করছে। এসব আচরণ দেখে মনে হয়েছে, ভিডিও নির্মাণের জন্য শিশুটিকে মানসিকভাবে চাপে রাখা হচ্ছিল।
বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট নির্মাতা ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পারিবারিক পরিবেশ, সন্তানদের কৌতুকপূর্ণ মুহূর্ত বা দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তুলে ধরেন। কিন্তু সম্প্রতি অনেকেই শিশুদের এই কনটেন্টে জোর করে বা মানসিক চাপে ব্যবহার করছেন, যা শিশু অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
শারমিন শিলা তেমনই একজন, যিনি ‘ক্রিম আপা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন নিজের তৈরি বিউটি প্রোডাক্টের প্রচারের মাধ্যমে। ভিডিওগুলোতে প্রায়ই তার ছেলে ও মেয়েকে দেখা যেত, কিন্তু বিশেষ করে মেয়েটির মুখে ভয় এবং অস্বস্তির ছাপ থাকত প্রায় প্রতিটি কনটেন্টে।
এই ঘটনার পরপরই শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘একাই একশো’ ৬ এপ্রিল ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে শারমিন শিলার বিরুদ্ধে একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এতে তারা উল্লেখ করেন, শারমিনের কনটেন্টে শিশু নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট এবং তা শিশুদের জন্য মারাত্মক মানসিক আঘাতের কারণ হতে পারে।
স্মারকলিপির ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেয় এবং তিন দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ, আইনজীবী, মনোবিজ্ঞানী এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ #SaveTheChild এবং #JusticeForKids ব্যবহার করে প্রচুর মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বিশিষ্ট শিশু মনোবিজ্ঞানী ডা. আফসানা রহমান বলেন, “এই ধরণের ঘটনার ফলে শিশুরা ভবিষ্যতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। জোর করে ভিডিও বানাতে বাধ্য করা এবং তাদের আবেগকে উপেক্ষা করা একটি প্রকারের নির্যাতন।”
বাংলাদেশের শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, কোনো শিশুকে মানসিক বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইনের ৭৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো শিশুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা তাদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে, তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
শারমিন শিলার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—
- শিশুদের মানসিক ও শারীরিকভাবে চাপে রাখা
- বিনা সম্মতিতে ভিডিও নির্মাণ
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে শিশুর দুর্বল মুহূর্ত প্রদর্শন
এসব অভিযোগ শিশুর মৌলিক অধিকার ও আইনি সুরক্ষার পরিপন্থী।
শারমিন শিলা মূলত একজন বিউটিশিয়ান হিসেবে নিজের পরিচয় দেন। তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে হোমমেড ক্রিম তৈরি করে থাকেন এবং ‘ক্রিম আপা’ নামে এই পণ্যের প্রচার ও বিক্রি করেন। তার ভিডিওগুলোতে প্রায়ই নিজের সন্তানদের ব্যবহার করে পণ্যের প্রচার চালান। শুরুতে তার ভিডিওগুলো মানুষের কাছে হাস্যরসের বিষয় ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিতর্কে রূপ নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জনের এই প্রবণতা অনেক অভিভাবককে ভুল পথে পরিচালিত করছে। ‘ভিউ’ আর ‘ফলোয়ার’ বাড়ানোর নেশা অনেককে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ বিসর্জন দিতে বাধ্য করছে।
এই ঘটনার পর অনেকেই বলছেন, এখন সময় এসেছে শিশুদের ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং অভিভাবক কর্তৃক নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়ার। বিশেষ করে কনটেন্ট নির্মাতাদের শিশুদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রয়োজন স্পষ্ট নীতিমালা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের নির্বাহী পরিচালক বলেন, “আমরা বারবার বলে আসছি, শিশুরা কোনো পণ্য নয়। তাদের দিয়ে ব্যবসা করা বা জনপ্রিয়তা অর্জনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা নৈতিক ও আইনি দিক থেকে সম্পূর্ণ অনুচিত।”
সরকারি সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, এই ধরণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শিশুদের সুরক্ষায় নতুন গাইডলাইন তৈরি করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
একজন মন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেন, “শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে, সরকার তা সহ্য করবে না। এই ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে।”
শারমিন শিলা ওরফে ‘ক্রিম আপা’-এর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি ডিজিটাল যুগে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল আচরণের প্রশ্ন তোলে। শিশুদের নিরীহতা ও অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কনটেন্ট নির্মাণ বা ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের চেষ্টা শুধু নৈতিক নয়, তা আইনি অপরাধও বটে।
এই ঘটনা দেশের অভিভাবকদের জন্য সতর্ক সংকেত হয়ে উঠেছে—সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাই এখনই সময় শিশুদের সুরক্ষায় সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার।