যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক ও বিতর্কের নতুন মোড়
স্ট্যাচু অব লিবার্টি—যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক এবং বিশ্বে মুক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই ভাস্কর্যটি নিউইয়র্কের লিবার্টি দ্বীপে প্রায় ১৫০ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্স এটি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে উপহার দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি ফ্রান্সের এক আইনপ্রণেতা এই প্রতীক ফেরত চাওয়ার দাবি তুলেছেন, যা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
ফরাসি সংবাদমাধ্যম ‘ফ্রেন্স টোয়েন্টিফোর’ জানায়, ফরাসি আইনপ্রণেতা রাফায়েল গ্লাকসম্যান যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা করে এই দাবি তুলেছেন। তিনি মনে করেন, যে মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে স্ট্যাচু অব লিবার্টি, তা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমেরিকা এখন স্বৈরাচারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাই, আমেরিকার কাছ থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি ফিরিয়ে নেওয়া উচিত ফ্রান্সের।
বিশ্লেষকদের মতে, রাফায়েল গ্লাকসম্যানের এই মন্তব্যের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন ইস্যুতে নেওয়া সাম্প্রতিক নীতির বিরোধিতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন ইউক্রেনে সাহায্য কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গ্লাকসম্যান মনে করেন, আমেরিকার নীতিগত পরিবর্তন এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে তাদের অবস্থান স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, “যে দেশ মানবাধিকারের কথা বলে, সেই দেশ যদি স্বৈরাচারী শাসকদের সমর্থন করে, তাহলে তার আর স্বাধীনতার প্রতীক ধরে রাখার অধিকার নেই।”
১৮৮৬ সালে ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি উপহার দিয়েছিল। এই মূর্তিটি স্বাধীনতার প্রতীক লিবার্টাসের রোমান দেবীর প্রতিচ্ছবি, যা মুক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি নিউইয়র্ক হারবারে দাঁড়িয়ে আছে, যা অভিবাসনকারীদের স্বাগত জানানোর প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়। মূর্তির ডান হাতে রয়েছে একটি মশাল, যা বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার আলো ছড়ানোর প্রতীক। বাম হাতে ‘টাবুলা আনসাটা’ রয়েছে, যেখানে রোমান অক্ষরে লেখা আছে ‘৪ জুলাই, ১৭৭৬’, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ। মূর্তির পায়ের নিচে ভাঙা শেকল, যা দাসপ্রথা বিলোপের প্রতীক।
গ্লাকসম্যানের বক্তব্য নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক মার্কিন নাগরিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই দাবিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আবার কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি ইউরোপ-আমেরিকা সম্পর্কের পরিবর্তনশীল গতিপথের প্রতিফলন। ইউক্রেন ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থানের সমালোচনা অনেক ইউরোপীয় নেতাই করেছেন, কিন্তু এই প্রথমবার কোনো আইনপ্রণেতা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি তুললেন।
এই দাবির বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে এটি ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতিচ্ছবি। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরেও রাজনৈতিক ও আদর্শগত পার্থক্য তাদের মধ্যে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
এই বিতর্ক শুধু স্ট্যাচু অব লিবার্টি নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার নতুন দিক উন্মোচন করবে।