জাতীয় সংসদ নাকি গণপরিষদ? রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ
নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি নিয়ে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ‘গণপরিষদ নির্বাচন’। সদ্য আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রথম থেকেই এই দাবিকে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার কেন্দ্রে রেখেছে। দলটির নেতারা বলছেন, বারবার ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে এবং শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন আনতে গণপরিষদ গঠন অপরিহার্য।
তাদের দাবি, এই গণপরিষদ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং এরপর হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে সব পক্ষ রাজি হলে, একইসঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। কিন্তু এই প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটি মনে করছে, এটি কেবলমাত্র জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি কৌশল।
এনসিপির নেতারা একাধিকবার স্পষ্ট করেছেন যে, গণপরিষদ ছাড়া রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাদের মতে, বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতে গঠিত সংসদ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে। গণপরিষদের মাধ্যমে গৃহীত নতুন সংবিধানের অধীনেই পরবর্তী সরকার পরিচালিত হতে হবে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন,
“সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া জনগণের প্রকৃত চাওয়া পূরণ সম্ভব নয়। গণপরিষদ হবে প্রকৃত গণতন্ত্রের সূচনা। এটি জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার কোনো ষড়যন্ত্র নয়।”
তাদের দাবি, গণপরিষদ নির্বাচিত সদস্যদের মাধ্যমে গঠিত হবে, যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করবেন। সংবিধান গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হলে, গণপরিষদই পরবর্তী সংসদে রূপ নেবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গণপরিষদের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারেন।
বিএনপি বরাবরই এই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচনই দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের একমাত্র পথ। সম্প্রতি এক ইফতার মাহফিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন,
“জাতীয় সংসদ নির্বাচনই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনা করতে গেলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে, যা আমরা মেনে নিতে পারি না।”
বিএনপির মতে, গণপরিষদের মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, গণপরিষদ গঠনের দুই ধরনের পদ্ধতি থাকতে পারে:
- নির্বাচিত গণপরিষদ: ৩০০ জনপ্রতিনিধি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এর পাশাপাশি ১০০ নারী সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের অনুপাত অনুসারে ১০০ সদস্য এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ২৫-৩০ জন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
- সংসদ ও গণপরিষদ একসঙ্গে কার্যকর: এই মডেলে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই নির্ধারিত সময়ে গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সপ্তাহে নির্দিষ্ট কয়েকদিন সংসদ সদস্যরা আইনসভা হিসেবে কাজ করবেন, আর বাকী সময় গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নের কাজ করবেন।
নেপালেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যেখানে একই ব্যক্তি সংসদ সদস্য ও গণপরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এনসিপির নেতাদের মতে, গণপরিষদ নির্বাচন হলে:
- দীর্ঘমেয়াদে সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।
- প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার অবসান ঘটবে।
- রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হবে।
- নাগরিকদের মৌলিক অধিকার আরও সুসংহত হবে।
এনসিপির নেতারা মনে করেন, বিএনপি প্রকৃত পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তরিক নয়। সারোয়ার তুষার বলেন,
“বিএনপি গণপরিষদ নিয়ে ভয় পাচ্ছে কারণ তারা শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন চায়, কাঠামোর পরিবর্তন নয়। তারা হয়তো এটাকে নিজেদের রাজনৈতিক পরাজয় মনে করছে।”
তবে বিএনপির দাবি, এই প্রক্রিয়া কেবল একটি নতুন রাজনৈতিক কৌশল, যা নির্বাচনের সময়সূচি পিছিয়ে দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে কিনা তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর। জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কঠিন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন,
“এনসিপির বাইরেও অনেক রাজনৈতিক শক্তি আগে থেকেই গণপরিষদের কথা বলে আসছে। এটি কোনো নতুন ধারণা নয়। রাজনীতিকরা এ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছালে বাস্তবায়ন সম্ভব।”
এনসিপির নেতা আরিফুল ইসলাম আদীব বলছেন,
“জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে হলে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে। সরকার চাইলে এ বছরের ডিসেম্বরে বা পরের বছরের জুন মাসে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।”
গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এনসিপি যেখানে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের পক্ষে, বিএনপি সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও, আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে, গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা ভবিষ্যতে দেশের গণতন্ত্রের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।