জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইফতার আয়োজনে বিপর্যয়
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতিতে লাখো রোহিঙ্গার ইফতার আয়োজিত হয়। তবে এই বিশাল আয়োজনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে পদদলিত হয়ে একজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয় এবং আরও দুজন আহত হন।
শুক্রবার (১৪ মার্চ) বেলা তিনটার দিকে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের (ক্যাম্প-৪ বর্ধিত) হ্যালিপ্যাড এলাকায় বিশাল ইফতার অনুষ্ঠানে পদদলনের এই ঘটনা ঘটে। নিহত রোহিঙ্গার নাম নেয়ামত উল্লাহ (৫০)। তিনি মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৪) সি ব্লকের বাসিন্দা।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সিরাজ আমীন জানান, প্রচণ্ড গরম ও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে নেয়ামত উল্লাহ ইফতারে অংশ নিতে গিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন এবং পদদলিত হন। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তাঁকে উদ্ধার করে একটি এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ক্যাম্প-৪ আশ্রয়শিবিরের ই-৫ ব্লকের রোহিঙ্গা আসাদ উল্লাহর ছেলে আসমত উল্লাহ (১৬) এবং একই ক্যাম্পের বাসিন্দা বশির আহমেদের ছেলে কলিম উল্লাহ (৬২)। তাঁদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জাহেদুল হাসান জানিয়েছেন, আহতরা শঙ্কামুক্ত রয়েছেন। তবে ভিড়ের চাপে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে এই ইফতার আয়োজন করা হয়। এতে এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অংশগ্রহণ করেন। ইফতার সামগ্রীর মধ্যে ছিল ভাত, ডাল, সবজি, খেজুর, শরবত এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী। আয়োজকরা জানান, এত বিশাল পরিসরের অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যার ফলে হুড়োহুড়ির সৃষ্টি হয়।
শুক্রবার দুপুরে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছান। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা শোনেন এবং বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। ক্যাম্পের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনকালে তিনি রোহিঙ্গা শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়ে খোঁজ নেন। তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও উদ্যোগী হতে হবে।”
বিকেলে ক্যাম্প পরিদর্শনে যোগ দেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু এই সংকটের সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে হতে হবে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও আন্তোনিও গুতেরেসের বিমান কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করে দুপুর ১২টা ৪৮ মিনিটে। বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। সেখান থেকে জাতিসংঘ মহাসচিব সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান।
রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এই সফরের মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। তিনি বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের একটি নিরাপদ, টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করছি। তাদের সমস্যার সমাধান দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় কাজ করছে। তবে প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব, নিরাপত্তা সংকট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব সংকট নিরসনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইফতার অনুষ্ঠান শেষে জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা ক্যাম্প ত্যাগ করেন এবং ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। আন্তোনিও গুতেরেসের চার দিনের সফরের অংশ হিসেবে তিনি আরও বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক বৈঠকে অংশ নেবেন। আগামী রোববার সকালে তার ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।
জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই সফর রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। মানবিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও আন্তোনিও গুতেরেস।